শনিবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৫

ভালবাসার গল্প

ভালবাসার গল্প






“কি মামা? ঘুমাও নাকি এখনো ?”
-ভকভক করে বেনসনের ধোঁয়া ছেড়ে প্রশ্ন করল নাভিদ ।
“নাহ ! কই আর ঘুমাই ! বিছানায় হাডুডু খেলি ।”
—ছুটির দিনে ‘ভোর’ দশটায় ঘুম ভাঙানোর কারণে বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলাম।
“আরে মামা! রাগ হও ক্যান ? আজকে তো গুরুর জন্মদিন ?”
—স্বভাবসুলভ ‘কিছুই হয় নাই’ ভঙ্গিতে বলল নাভিদ ।
আমি খানিকটা ইতস্তত বোধ করলাম । নাভিদের স্বভাব , লালন থেকে লিঙ্কিন পার্ক প্রায় সবাই তার কাছে গুরু । আজকে আবার তাদের মধ্যে কোন গুরুর জন্মদিন , কে জানে ? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম-
“কোন গুরু?”
নাভিদ আবার সর্বদাই তার ‘গুরু’-দের ব্যাপারে দুই ফারেনহাইট বেশি সিরিয়াস । গম্ভীর স্বরে বলল –
“শে গেভারা , সবাই যার ভুল উচ্চারণ করে চে গুয়েভারা বলে ।”
এতোটুকু বলে সে আবার খানিকটা সময় নিল ভকভক করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ার জন্য ।
আমি প্রমাদ গুনলাম । মাসখানেক আগে আমাদের হাতে চে গুয়েভারার একটা জীবনী আসে । ওটা পড়েই সবার মাথায় সুমহান বিপ্লবের পোকা ঢোকে । কিছুদিন আগে দলবেঁধে চে-র ছবিওয়ালা টি-শার্ট আর গেঞ্জি কিনে নিয়ে আসা হয় , যার বেশিরভাগগুলোতেই “মানুষের মুক্তির চিরন্তন চেতনা” এরনেস্তো চে গুয়েভারা ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট নিয়ে সৌম্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন । এসব আবোতাবোল ভাবছিলাম এমন সময় রুমে এসে ঢুকল রিফাত । রিফাতের গায়েও নাভিদের মতোই চে-গুয়েভারার ছবিওয়ালা ট-সার্ট ।
রিফাত , নাভিদ আর আমি – আমরা তিনজন রুমমেট । নাভিদ ছেলেটা যেকোন কিছুতেই ব্যপক আশাবাদী । যেসব পরীক্ষায় আমরা নেহায়েৎ পাশ করলেই বাঁচি , সেসব পরীক্ষায় সে এ প্লাস পাবে বলে আশার বসতি গড়ে । আর এটা বলাই বাহুল্য সেই বসতি ভাঙতে সময় লাগে না । কিন্তু তবুও নাভিদ ভাঙে তো মচকায় না । অপরদিকে রিফাতের দাবী , জগতে কেবল দুইটা জিনিসই ক্রমবর্ধমান । এর মধ্যে একটা হল এনট্রপি , আরেকটা হল হতাশা । আর এই দুই বিপরীত প্রবৃত্তির মানুষের সাথে বসবাস করতে গিয়ে কেমন যেন একটা ‘অনিকেত প্রান্তর’-এ ঝুলতে থাকি আমি । না পারি প্রবল আশায় বুক বাঁধতে , আবার না পারি তীব্র হতাশায় শ্লাঘা ত্যাগ করতে ।

যাই হোক রিফাত রুমে ঢুকেই হতাশার ঝাঁপি খুলে বসল –
“এই যে আজকে যারা চে গুয়েভারার জন্মদিন নিয়ে এতো মাতামাতি করছে , বিপ্লব আর পরিবর্তনের তুবড়ি ছুটিয়ে মুখ দিয়ে ফেনা তুলে ফেলছে , তাদের মধ্যে কতোজন আসল ইতিহাস জানে ? আমার তো মনে হয় ঠিকভাবে জিজ্ঞাসা করলে অনেকে উনার দেশটাও বলতে পারবে না । ”
এসব শুনে নাভিদ তার আশার ডালি উজাড় করে দিয়ে বলল –
“তোরে কইসে ? হয়তো কয়েকজন জানবে না । তাদের জানা না জানাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু অধিকাংশই জানবে ।” ।
এই নিয়ে দুজনের বাকবিতন্ডা যখন ঊর্ধ্বগামী ঠিক তখনই নাভিদের তরফ থেকে একটা বাজির প্রস্তাব আসে । প্রস্তাব হল তারা ঠিক এই মুহূর্তে ক্যান্টিনে যাবে এবং কমপক্ষে ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশজনকে চে সম্পর্কে কিছু বেসিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে । তারা উত্তর দিতে পারলে নাভিদ জিতবে , আর না পারলে রিফাত হারবে । কিন্তু বাজি ধরা হবে কিসের উপর ?
ক্ষণকয়েক বাদে সিদ্ধান্ত হল বাজি ধরা হবে এক প্যাকেট বেনসনের উপর । বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মোটামুটি বেশ উচুদরেরই বাজি ।
যাই হোক তাদের সাথে আমিও গিয়ে বসলাম ক্যান্টিনে । কে জিতে বাজিটা দেখা দরকার ! এখন প্রশ্ন হল ঠিক কাদেরকে প্রশ্নগুলো করা হবে । এ ব্যপারে দুজনে বেশ কিছুক্ষণ উঁচু স্বরের বাক্যালাপ শেষে সিদ্ধান্ত নিল অর্ধেক মানুষ বাছাই করবে নাভিদ , আর বাকি অর্ধেক রিফাত ।
প্রথমেই ক্যাম্পাসে পরিবর্তনের ছোঁয়া এনে দিতে সদা তৎপর এক তরুণকে ডাকা হল । এই তরুণকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি । সে অনলাইনের জগতের একজন ছোটখাটো সেলিব্রেটি । সমাজের যাবতীয় অসমীচীনতা নিয়ে লেখা তার বিশাল বিশাল স্ট্যাটাসগুলোতে প্রায়শই লাইকের বন্যা বসে । তরুণকে প্রশ্ন করা হয় , চে গুয়েভারার জন্ম কোন দেশে ? আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম এই প্রতিবাদী তরুণ অবশ্যই পারবে । কিন্তু আমাকে আর নাভিদকে অবাক করিয়ে দিয়ে সে উত্তর দিল আফ্রিকা । আমরা তিনজনই খানিকটা নড়েচড়ে বসলাম ।
এরপর অফলাইনের জগতে বিভিন্ন মিছিলের স্লোগানে দেশ পরিবর্তনে দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ আরেক বিপ্লবী তরুণের কাছ থেকে জানা গেলো চে গুয়েভারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন তেজী যোদ্ধা ! এভাবে প্রায় ত্রিশজনকে প্রশ্ন করা শেষ । ফেসবুকে চে-এর ছবি কভার ফোটো দেয়া ছেলে থেকে শুরু করে তাঁর ছবিওয়ালা গেঞ্জি পড়ে তাঁর স্টাইলে সিগারেট ফুঁকতে থাক ছেলেটা , বিশ্বের প্রায় সব বিশয় নিয়ে গুরুগম্ভীর কথা বলা ছেলেটা থেকে শুরু করে নারী অধিকারে সোচ্চার হয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দেয়া মেয়েটা --- সকলের বিমূর্ত উত্তরে আমাদের রীতিমতো ‘তবদা’ লেগে যাওয়ার দশা । নাভিদ বাজিতে হেরে হতাশ , রিফাতকে জিতেও তেমন খুশি হতে দেখা গেলো না ।
এমন সময় নাভিদ একটা ছেলেকে ডাকলো । ছেলেটার চুল তেল দিয়ে পরিপাটি করে আঁচড়ানো , বড় কার্বন ফ্রেমের চশমা । মোটের উপর , দেখলেই বুঝা যায় এই ছেলে বিপ্লবের ধারেকাছেও নাই । ছেলেটার সম্পর্কে অল্প বিস্তর যতদূর জানি , তাতে বিপ্লব শব্দটার ধারকাছ দিয়ে তাঁর থাকার কথা নয় । সিস্টেম পরিবর্তন নয় বরং সিস্টেমে খাপ খাওয়ানোই এদের লক্ষ্য হয়ে থাকে । নাভিদ তাকে জিজ্ঞাসা করল চে গুয়েভারার নাম শুনেছে কিনা । ছেলেটা নির্লিপ্ততা জড়ানো কন্ঠে বলল –
“হুম চিনি তো । প্রায়ই দেখা হয় ।”
আমরা তো পুরো থ হয়ে গেলাম । বলে কি পাগলে ? আমরা জানতে চায়লাম তার মাথা থিক আছে কিনা !
ছেলেটা একটু হেসে বলল –
“ক্যান্টিনের টেবিল বয় মামুনকে চেনো ? ছেলেটা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে কাজ করে আর রাতে নৈশ স্কুলে পড়ে । গত বার্ষিক পরীক্ষায় পঞ্চম হয়েছে সে । আমাদের ডিপার্টমেন্টের দপ্তরী রফিক মিয়াঁকে কে চেনো ? সকাল থেক বিকাল পর্যন্ত দপ্তরীর কাজ করে রাতে গিয়ে আবার চায়ের টং চালায় একটা । তার এক ছেলে এবার এস,এস,সি, পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে । হাসান আলীকে চেনো ? রিকশা চালায় । ঘরে চারটা ছেলেমেয়ে আছে । তবুও রাস্তা থেকে কুরিয়ে পাওয়া এক মেয়েকে মানুষ করছে , পড়ালেখা শেখাচ্ছে ।
আমার কাছে এদের সহ এরকম আরো অনেকের জীবনটাই একটা বিপ্লব মনে হয় । প্রতিটা পদক্ষেপই এক একটা প্রতিবাদী মিছিলের তীব্র শ্লোগান । তাই চে-এর সাথে আমার হরহামেশাই দেখা হয় হয় , পরিচয় হয় , কথা হয় । হয়তো তোমাদেরো হয় , কিন্তু তোমরা পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে যাও । তোমরা যে ধরেই নিয়েছো ওখানে তাঁকে তোমরা খুজবে না । ”
এই কথাগুলো বলেই সূর্যটাকে ছাতা বানিয়ে রোদের পথে বেরিয়ে গেলো ছেলেটা ।
নাভিদ উঠে গেলো কয়েক সেকেণ্ড পর , আর তারপর রিফাতও । মিনিট পাঁচেক পর দুজনেই আবার ফিরে এলো । দুজনের হাতেই ১৭০ টাকা দামের দুটো বেনসনের প্যাকেট । একই বাজিতে দুজনের একসাথে হেরে যাওয়ার ঘটনা বোধহয় এই প্রথম ।
“ছেলেটা কে রে ?” চেয়ার টেনে বসতে বসতে প্রশ্নটা করল নাভিদ ।
“চে ! চে গুয়েভারা ! বাবা কৃষক , মা অসুস্থ । গ্রামের বাড়িতে থাকে স্কুল পড়ুয়া ছোট ভাইটার সাথে । ও টিউশন করে নিজেকে চালায় , সেইসাথে পরিবারটাকেও । ” –
রোদকে মাড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া ছেলেটার পথের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন