সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ভালবাসার গল্প

ভালবাসার গল্প



১।
সময় এখন বিকেল এবং সন্ধ্যার মাঝামাঝি। অর্থাৎ আর আধ ঘন্টা পর সন্ধ্যা হবে। সূর্য লাল হতে শুরু করেছে। মিলি দোতলা থেকে খুব সাবধানে রেলিঙ ধরে ধরে নিচে নামল। এ কাজটা আপাতত ওর জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ ও প্রেগনেন্ট, যেকোন সময় ব্যথা উঠতে পারে। তাও নেমেছে। নিজের সাহস দেখে সে মুগ্ধ। নেমেই দেখা হয়ে গেল কবীর চাচার সাথে। কোথাও থেকে ফিরলেন। তিনি নিচতলায় ভাড়া থাকেন। একা মানুষ; স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পর এখানে উঠেছেন। তার ভাষায়, "আমি এখন বেহেশতে আছি।" মিলিকে দেখে তিনি একটু অবাক হয়ে বললেন, "একা একা নেমেছ নাকি?" মিলি হেসে মাথা নাড়ে। "তোমার হাজব্যান্ডকে দেখলাম পুকুর পাড়ে বড়শি নিয়ে বসা। তার সাথে নামতে। কাজটা তোমার মোটেও ঠিক হয়নি। সাবধানে থেকো বুঝলে?" এই বলে তিনি ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলেন। মিলির মনটা একইসাথে অবাক এবং ভাল হয়ে গেল। সাধারণত অপরিচিত কারো মমতা আমরা সহজে গ্রহণ করতে পারিনা। ভাবি এই মমতার পিছনে হয়ত স্বার্থ লুকিয়ে আছে। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে এই ভাবনা সঠিক হয় না হবে না।
একহাত পেটের উপর রেখে ধীরে ধীরে মিলি বড় জাম্বুরা গাছটার কাছে এলো। গাছের
সামনে ঘোলা জলের পুকুর। তার পাড় ঘেষে আসাদ বসে আছে। বড়শি হাতে স্থির, যেন
একটু নড়লেই মহাসর্বনাশ হয়ে যাবে। মিলি ডাক দেয়, "এ্যাই।" ওকে দেখে আসাদের চোখ প্রথমে বড় বড় তারপর সরু হয়ে গেল। বলল, "নামলে কিভাবে?"
"একাই। সারাক্ষন ঘরের মধ্যে আর কত থাকা যায়? তুমি তো ফিরেই বড়শি নিয়ে বসে
যাও, তোমার আর চিন্তা কি?"
"তাই বলে... তুমি জানো? সুস্থ মানুষই অনেক সময় সিড়িতে ওঠানামা করতে গিয়ে
হোচট খায়। আর তুমি তো অসুস্থ। শরীরের উপর যেন চাপ না পড়ে সেজন্য নিজে
তোমাকে গোসল করিয়ে দিই আর তুমি কিনা..."
"গোসল তো করাও আমার শরীর দেখার জন্য।"
"ছিঃ ছিঃ মিলি, কথাটা এভাবে না বললেও পারতে।"
মিলি হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে ঘেষে রইল আসাদের গায়ের সাথে। নিরিবিলি
পুকুরের চারিধার থেকে সে হাসির প্রতিধ্বনি উঠছে। আসাদ মুগ্ধ হয়ে শোনে।
মায়ার চোটে বলতে যেয়েও পারেনা - "এ্যাই এত হাসে না, পেটে চাপ পড়বে।"
.
মাঝরাত। কি কারণে হঠাৎ মিলির ঘুম ভেঙ্গে গেল। কোন খারাপ স্বপ্ন দেখল কিনা তাও মনে করতে পারছে না। ফ্যানের বাতাসেও সমস্ত শরীর ঘামে চুপচুপ। অসহ্য গরম লাগছে। ইচ্ছে হচ্ছে সব কাপড় খুলে ফেলতে, এবং তাই করলো। রান্নাঘর থেকে খুটুর খুটুর শব্দ আসছে। ভয় পেয়ে আসাদকে জোরে ধাক্কাতে থাকে, "এ্যাই, এ্যাই উঠোনা! উঠো!"
আসাদ মুড়িয়ে ওঠে। ঘুম জড়ানো গলায় ক'বার বলল, "কি হয়েছে?"
মিলি এবার শান্ত। আরও কিছুক্ষন চুপ থেকে আস্তে করে বলল, "কিছুনা, তুমি ঘুমাও।"
তারপর সে-ও শুয়ে পড়ে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঘুমের ঘোরে আসাদের একটা হাত ওর পেটের উপর এসে যায়। মিলিও হাত রাখে। ঘুমে দু'চোখ বুজে আসছে। বড় ভাল লাগছে
এখন, অনেক ভাল।
২।
চা খেয়ে কাপটা টেবিলের পাশে রাখতে রাখতে পিয়ন এসে নিয়ে গেল। আসাদ একটা ফাইলে কাজ করছে আর কলিগদের সাথে গল্পেও যোগ দিচ্ছে। এই দুটো জিনিস একসাথে
করতে গিয়ে তার প্রায়ই কাজে ভুল হয়। জিএম এপর্যন্ত তাকে দুবার ওয়ার্নিং দিয়েছেন, আরেকবার দিলেই চাকরি নট্। আসাদ তাও গল্প করে। শুধু গল্প না, অফিসের আর্থিক হিসাব-নিকাশেও তার কিছু ফাক-ফোকর আছে। জলিল সাহেবকে পানি দিতে এসে পিয়ন ওকে বলল, "স্যার, জিএম স্যার আপনারে ডাকে।"
সে মিটমিট হাসছে। আসাদের কপালে চিন্তার ভাজ। বাকিদের মুখেও গম্ভীর। কি ঝামেলা হল কে জানে। তার উপর পিয়নকে হাসতে দেখে বলল, "কি ব্যাপার হাসো কেন?"
"জিএম স্যারের চেহারা দেখলাম পাথরের মতন হইয়া রইছে। এইবার মনেহয় আপনে
লাস্ট ওয়ার্নিং খাইয়াই যাইবেন।" আসাদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াল। এদের তামাশা শোনার সময় এখন না। গেলেই বোঝা যাবে আসোল বিষয় কি।
রাত দশটার কিছু বেশি। বাইরে ভীষণ ঝড়। ঘন ঘন বাজ পড়ছে। তার উপর কারেন্ট নেই অনেকক্ষন। গত বিশ মিনিট যাবত মিলি প্রচন্ড ব্যথায় কাতরাচ্ছে। প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়েছে ওর। বারবার বলছে, "চাচা আসাদকে একটু ফোন দেন না! ও বুয়া, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।" বুয়া হল মিনার মা, এ বাসায় কাজ করে। কবীর চাচা তাকে খবর দিয়ে এনেছেন।
মিনার মা একাধারে হাতপাখায় বাতাস করছে, মাথায় হাত বুলাচ্ছে। একসময় ভয়ার্ত স্বরে বলল, "ভাইজান, যা করার তাত্তাড়ি করেন। মাইয়াডার মুখখান নীল হইয়া যাইতাছে অবস্থা কিন্তু বেশি ভালা ঠেকতাছে না।"
"আসাদকে তো ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন বন্ধ। এই ঝড়ের মধ্যে কিযে করব বুঝতে পারছি না।"
কবির চাচা চিন্তিত মুখে পায়চারি করে চলেছেন। তার ব্রেন কাজ করছে না, সব কেমন গোলমেলে লাগছে। এমনসময় কলিংবেল বেজে উঠল। মিলি চিৎকার দিল, "ও আসছে..."
ওর কন্ঠ আগের চেয়ে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। চোখের পানি, ঘাম মিলেমিশে একাকার। সম্পূর্ণ ভেজা শরীরে আসাদ ঘরে ঢুকল। কবীর চাচা ধমকে উঠলেন, "তুমি ফোন বন্ধ রেখেছ কেন?"
"চার্জ চলে গেছিল।"
"স্টুপিড কোথাকার।" এটা অবশ্য সরাসরি বললেন না, মনে মনে। মিলির অবস্থা দেখে আসাদের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বলল, "এখন কি করব চাচা? বাইরে যা ঝড়, অ্যাম্বুলেন্স তো..."
ওর কথার মাঝেই মিনার মা চট করে বলে উঠল, "অহন আর এইসবের সময় নাই। এক
মহিলার কথা মনে আইছে। হ্যায় অনেকের নরমাল ডেলিভারি কইরা দিছে। দেহি তারে
পাই কিনা।" বলেই সে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। কবির চাচা চোখ বন্ধ করে দাড়ানো। আসাদ মিলির পাশে বসে ওর মাথায় একটা হাত রাখল। মিলির গলা দিয়ে আর কোন শব্দ বের হয় না। শরীর কাঁপতে থাকে অবিরত। কি মনে করে আসাদ হঠাৎ কবীর চাচাকে ডেকে বোকার মত বলে ফেলল, "চাচা আমার চাকরিটা চলে গেছে।" তিনি এবার সরাসরিই বললেন, "খুব ভাল হয়েছে। আরও আগেই যাওয়া উচিত ছিল।"
মিনার মা কথামত সেই মহিলাকে নিয়ে আসলো। তার কয়েক মিনিটের মধ্যে জিনিসপত্র
জোগাড় করে তারা মিলির ডেলিভারি সম্পন্ন করলো। মিনার মা দরজা খুলে থমথমে চেহারায় আসাদের দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে বলল, "বাচ্চাটারে বাঁচান গেল নাগো।" আসাদ মিলির কাছে এসে বসে। স্ত্রীর অচেতন মুখটা দেখে চোখের পানি আর ধরেরাখতে পারল না, কেঁদে ফেলল। আজ এই বাড়িতে একজন নতুন অতিথির কান্নায় চারপাশ মুখরিত হবার কথা ছিল কিন্তু হল না। প্রকৃতি যেটা চায় না, তা কারো পক্ষেই করা সম্ভব নয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন