সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

নিঃসঙ্গতা

নিঃসঙ্গতা
কড়া রোদ উঠেছে। বসন্ত নয় যেন কাঠ ফাটা গ্রীষ্মের আগমন। পান্থ ফুলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। না,ফুল কেনা উদ্দেশ্য নয়। এতক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে ঘেমে নেয়ে গেছে শরীর। একটু ছায়ার সন্ধানে ফুলের দোকানের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা। রিকশা চড়ে বাজে খরচ করার মত অবস্থা নেই এখন, পকেটে হাত দিলেই গড়ের মাঠের মত পকেট তা মনে করিয়ে দেয়। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালই লাগছে পান্থের। দল বেঁধে তরুণ- তরুণীরা আসছে আর ফুল কিনছে। কেউ কেউ পরম যত্নে খোঁপায় গুঁজে দিচ্ছে ফুল। কি সুখ চারিপাশে! এদের দেখতে হয়তো ভাল লাগে,কিন্তু দীর্ঘশ্বাস টা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে। তার কপালেও কি এমনটা লিখা থাকতে পারতনা? নীলিমার কথা খুব মনে পড়ছে আজকে। ব্যস্ততা আর পেটের চিন্তা করতে করতে নীলিমা চাপা পড়ে থাকে মনের কোন এক কোণে। তবে আছে সে, মনের মাঝেই। মাঝে মাঝে জেগে ওঠা চিনচিন ব্যথার কারন সে। বড় শাসন করত তাকে নীলিমা। ঠিকমতো খায়না কেন, পড়ায় মন দেয়না কেন, এত গুলো টিউশনি করে শরীরের উপর এত চাপ ফেলছে কেন,কত শত অভিযোগ ছিল মেয়েটির। কি করবে সে? বাড়িতে গরিব মা আর বোন।নিজের খরচ চালিয়ে বাড়িতেও কিছু টাকা পাঠাতে হয়। পান্থের ঘুমহীন নিষ্প্রাণ চোখ দেখলেই নীলিমার মুখ শুকিয়ে এতটুক হয়ে যেত। পান্থ প্রায় ই ভাবত তার মত চালচুলোহীন মানুষের জন্য মেয়েটি এত ভালবাসা কিভাবে জমিয়ে রেখেছে?
“ফুল কিনবেন ভাইজান?”
দোকানীর কথায় বাস্তবে ফিরে আসল পান্থ।
“না ভাই,ফুল সবার হাতে মানায় না।“ বলে হাঁটা ধরল পান্থ।
কালকে ভালবাসা দিবস। এসব ঠুনকো জিনিস নিয়ে ভাববার অবকাশ নেই তার। তবুও ঘুরে ফিরে মাথায় চলে আসে ভালবাসা দিবস আর নীলিমা। হয়তো আজও তার পাশে থাকতে পারত নীলিমা। কিন্তু এতটা স্বার্থপর হতে পারেনি পান্থ। তার সাথে কখনও ভাল থাকতে পারতনা নীলিমা। অভাব অনেক ভয়ংকর জিনিস। ভালবাসা দিয়ে পেট চলেনা। নীলিমা একমাত্র মেয়ে ছিল তার বাবা মার। পান্থের সাথে পরিচয়ের আগে থেকেই বিয়ের আলাপ আসত তাদের বাসায়। নীলিমার ইচ্ছে ছিল পড়া শেষ করে বিয়ে করবে। কিন্তু নীলিমাকে বিয়ে করে তাকে মাথা গোঁজার ঠাই টুকু দেয়ার ক্ষমতাও ছিলনা পান্থের। এখনও বেকার সে। নীলিমাকে অবহেলা করে করে দূরে সরিয়ে দিয়ে ভালই করেছে পান্থ। নীলিমাকে কখনও বুঝতেও দেয়নি তার অবহেলা কতটা মিথ্যা ছিল। নীলিমা কষ্ট পেত আর সে নিজেই পুড়ে মরত নিজের মাঝে। নীলিমা এখন সুখে আছে। স্বামী,সংসার,সন্তান নিয়ে। হ্যাঁ,পান্থ এটাই বিশ্বাস করতে চায় যে নীলিমা ভাল আছে। স্বামীর ব্যস্ততায় অভিমান করে ছলছল করছে চোখ। সে নিজে ভাল নেই তাতে কিছু যায় আসেনা। ভাল থাকা সবার কপালে থাকেনা।
আজ ভালবাসা দিবস। পান্থের খুব ইচ্ছে করছে তার আর নীলিমার প্রিয় জায়গা টাতে কিছুটা ক্ষণ কাটিয়ে আসতে। একটা চাকরীর ইন্টারভিউ আছে আজকে। তাতে কি? ফলাফল তো শূন্যই আসে। তারচেয়ে একটা দিন নাহয় তার দুঃখে শান দিয়েই কাটুক। পান্থ হাঁটতে থাকে গন্তব্যের দিকে আর বিড়বিড় করতে থেকে নীলিমার প্রিয় কবিতা।
“তোমারও কি কিছু কথা ছিল
কিছু নীল ব্যর্থতা
আজীবন নির্বাক অপেক্ষার সাহস
কিছু লালিত বেদনা,
কিছু বিপরীত নদীতে ফেলে আসা
নিজস্ব প্রতিকৃতি,
আমার কিছু কথা ছিল, দুঃখ ছিল,
আমার কিছু তুমি ছিল তোমার কাছে...”
গন্তব্যে পৌঁছে এই দৃশ্যটির জন্য প্রস্তুত ছিলনা পান্থ। স্থির হয়ে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ধরে রাখা ছোট্ট মেয়েটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। তার মা কাঁদছে। মাঝে মাঝেই তার মা খুব কাঁদে,কিন্তু লুকিয়ে। আজ মা তার সামনেই কাঁদছে। কিছু কান্না আশেপাশের মানুষকেও তার তীব্রতা বুঝিয়ে দিয়ে যায়। ছোট্ট মেয়েটিও যেন তার মার কষ্ট বুঝতে পারছে। কাঁদতে থাকা মেয়েটি আর কেউ নয়,নীলিমা। এতটা বছর পরও নীলিমা তাদের প্রিয় জায়গায় এসে চোখের পানি ফেলছে! এতক্ষণ পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল পান্থ।নীলিমা দেখতে পায়নি পান্থকে। নীলিমার সাথে মাত্র একটা বার দেখা করার খুব লোভ জাগছে পান্থর। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল সে। নাহ, এ মায়ায় আর জড়ানো যাবেনা নিজেকে।
পান্থ ফিরে চলে। বেঁচে থাকার জন্য আজকের এই কষ্ট টুকুর বড় বেশি প্রয়োজন ছিল।
“হাত বাড়ালেই ফুটে থাকা
রক্তিম গোলাপ-
তবু যে যার কাঁটার কাছে
ফিরে যায় একদিন,
একদিন যে যার নিঃসঙ্গতার কাছে”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন