সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

পুতুলের ভাঙ্গা পায়েল

“পুতুলের ভাঙ্গা পায়েল”
এলোমেলো চুল আর কালো ফ্রেমের চশমা পরা ভরাট মুখের কোন ছেলে দেখলে এখনো বুকটা কেঁপে উঠে মেয়েটার। অপরিচিত ছেলেটার দিকেই কেমন তৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। ওরকম এলোমেলো একটা মানুষের সাথেই সারাজীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখেছিলো সে। মোটা গ্লাসের ভেতরে লুকিয়ে থাকা একজোড়া অসম্ভব মায়াবী চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হত এই চোখের মালিকের জন্য সে পৃথিবীতে সব ছাড়তে রাজি। ছেলেটা মেয়েটাকে ডাকতো পুতুল। আর মেয়েটা ডাকতো মুটু বলে।
পূর্ণিমার চাঁদ দেখে মেয়েটা ছেলেটাকে বলত, “দেখো, তোমার পেটের মত একটা চাঁদ উঠছে আজ...” ছেলেটা হাসতো। রেলিঙে পা ঝুলিয়ে চাঁদটাকে সাক্ষী রেখে কত স্বপ্নই না সাজিয়েছিল তারা। “আমার জানালায় কিন্তু আমি সাগররঙ্গা পর্দা টাঙ্গাবো...” ছেলেটা হাসতো। “শোন, আমি যখন রান্না করব তুমি কিন্তু আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করবা। নইলে আমি রান্নাই করব না...” ছেলেটা আবারও হাসতো। মেয়েটার চোখে পানি চলে আসতো। “এত ভালবাসো কেন আমাকে?” “এটা কোন প্রশ্ন হল? কি যে জিজ্ঞেস কর না তুমি...” মেয়েটার একটা পায়েল ছেলেটার খুব পছন্দ ছিল। পায়েলটা ভেঙ্গে গেলে মেয়েটা সেটা তুলে রেখে দেয়। “তোমার নজর লাগছে আমার পায়েলটার দিকে। যাও, ভাঙ্গা পায়েলটা তোমাকে দিয়ে দিব। যত্ন করে রেখে দিবা।”
মেয়েটার পাগলামি দেখে খুব হাসত ছেলেটা। “পুতুল, তুই আমার লাল টুকটুক বউ হবি?” মেয়েটা হাসত আর কাঁদত। দুনিয়াটা অসম্ভব সুন্দর মনে হত। হাতে হাত রেখে চলাটাও যেন কত সহজ। তারপর একদিন সবাই জেনে যায়। ছেলেটার কাছ থেকে পুতুলটাকে জোর করে নিয়ে গেল ওর বাবা মা। “আমরা কি কখন তোর খারাপ চাইব, মা?” “অনেক ভাল একটা প্রস্তাব এসছে। তুই রাজি হয়ে যা মা...” অনেক কাঁদে পুতুলটা। রুমের দরজা বন্ধ করে মুখ চেপে কাঁদে। বাবা যাতে না শুনতে পায়। কিছুদিন আগেই যে বাবার হার্টের অপারেশন হল। বাবাটা যদি মরে যায়?
বাস্তবের পুতুলদের কখন এত সাহস থাকে না। বাবা মা নাড়ীর টান সব ছিঁড়ে ফেলে ভালবাসার মানুষটার হাত ধরে চলে যেতে পারে না। বাবার মুখটা মনে পড়ে। কত কষ্ট করে বাবা এতদিন এত আবদার মিটিয়ে মানুষ করেছেন। যে মা টা মেয়েকে একটা ভাল জামা কিনে দেয়ার জন্য নিজে একটা ভাল শাড়ী পরে না সেই মাকে ছেড়ে পুতুলটা কিভাবে থাকবে? আর ওই মানুষটা? যাকে নিয়ে সারাটা জীবনের স্বপ্ন সাজানো আছে... যার সাথে একদিন কথা না বললে দম বন্ধ হয়ে যায়... ছেলেটা কিন্তু পুতুলটার হাত ছাড়ে না। কেন ছাড়বে? এতগুলো দিন ধরে তো সে মিথ্যা বলে আসেনি তার পুতুলটাকে। “কক্ষনো তোর হাতটা ছাড়বো না... দেখিস তুই...” কিন্তু বাস্তবের পুতুলরা কলিজা ছেড়া কষ্ট সহ্য করে বাবা মার আদর্শ মেয়ে সেজে সারাজীবনের স্বপ্ন বিসর্জন দেয়। সেই মানুষটার হাত থেকে হাতটা ছাড়িয়ে আনে যার জন্য ভেবেছিল সারা দুনিয়া ছাড়তে পারবে। জন্মের ঋণ শুধায়। অপরিচিত একটা মানুষের হাত ধরে। তারপর...??? হয়তোবা ভালই থাকে।
এত কর্মব্যস্ত জীবনে হয়ত মুটু নামের ছেলেটা হারিয়ে যায়। আদৌ হারায় কি? ভাঙ্গা একটা পায়েল কিংবা একবক্স শুকনো গোলাপ দেখলে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠে। যক্ষের ধনের মত সেগুলো আগলে রেখে দিয়েছে পুতুলটা। একজীবনে আরো অনেক ঋণ শুধানোর আছে যে...
------পুতুল

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন