গাছঘর কিংবা এক হারানো বন্ধুর গল্প
আমাদের বাসায় মেলামাইনের থালা , বাটি কিংবা গ্লাসের প্রথম ব্যবহার শুরু হয় আমার কারণে । শুরু হয় না বলে বলা উচিত বাসার মানুষজন এগুলোর ব্যবহার শুরু করতে বাধ্য হয় । নিজের হাতে খেতে শেখার পর আমার প্রধানতম কাজ ছিল খাওয়ার পর প্লেট কিংবা গ্লাস যতোটা সম্ভব দূরে ছুঁড়ে মারা । কি খাচ্ছি , কখন খাচ্ছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ না – বরং প্রতিবার খাওয়া শেষে প্লেট বা থালা কিংবা গ্লাসটা কতোটা দূরে ছুঁড়ে মারতে পারছি সেটাই ছিল আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ । বিবিধবার বিবিধ রকমের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল আমার এই ভাংচুর কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে । কিন্তু আমাকে আমার অবস্থান থেকে একচুলও সরানো যায় নি ।
এই দেখে আমার মা বুঝতে পারেন তার ছোট ছেলের হাতে , পায়ে কিংবা মাথায় অফুরান সময় এবং ফলশ্রুতিতে সিদ্ধান্ত নেন আমাকে যেকোন সৃষ্টিশীল কাজে লাগিয়ে দিতে হবে । নচেৎ আমার হাতে থাকা এই ব্যপক খালি সময়কে কাজে লাগিয়ে আমি একদিন নামী পিকেটার হয়ে উঠতে পারি । পেশা হিসেবে পিকেটিং যতোই ভালো হোক না কেন – কোন মায়েরই সেটা ভালো লাগার কথা না । আমার মায়েরও লাগে নি । তাই আমাকে ব্যস্ত রাখার উপায় খুঁজতে লাগলেন ভদ্রমহিলা।
মা গান গাইতে পারতেন ; এখনো পারেন । রেডিওতেও গেয়েছিলেন তার বালিকাবেলায় । তাই তার মনে প্রথম যে ভাবনা এলো সেটা হল গান । আমার চেয়ে নয় বছরের বড় আমার একমাত্র ভাইও ভালো গাইতে পারে । তাই গান শেখানোর প্রাথমিক দায়িত্ব পড়লো তার উপর। আমার বড় ভাই আমাকে প্রবল উৎসাহে গান শেখাতে শুরু করে দিল । এখনো স্পষ্ট মনে আছে নাথ এন্ড কোং-এর একটি সুপ্রাচীন হারমোনিয়ামের রিডগুলোতে ছোট ছোট স্টিকার লাগিয়ে তাতে সুন্দর করে সারেগামা লিখে দিয়েছিল দাদা। এরপর শুরু হল আমার সুদীর্ঘ (!) সঙ্গীতজীবন ।
কিন্তু ঐ পর্যন্তই । যতোক্ষণ ধরে আমার দাদা আমাকে সরগম শেখানোর চেষ্টা চালাতেন ততোক্ষণ আমার নজর থাকতো হারমোনিয়ামের বেলোগুলোর (হারমোনিয়ামের যেই ফ্র্যাট ধরে টানা হয় তাতে থাকা ছিদ্রগুলো) দিকে । দুমদাম ঐ ছিদ্রগুলোর মাঝে আঙুল কিংবা কাগজের টুকরা বা অন্যকিছু ঢুকিয়ে দিতাম । আর বাজাতে দিলেই স্টিকারগুলো টেনে টেনে তুলে ফেলতাম । সেই বয়সেই আমার দাদা যথেষ্ট ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিয়েছিল । কিন্তু এতোটা নয় যে আমাকে হারমোনিয়ামের সামনে এতোগুলো দিন বসিয়ে রাখতে পারবে । দাদা সপ্তাহ দুয়েকের মাঝেই হাল ছেড়ে দিয়েছিল । কিন্তু মা সেটা বুঝতে লাগিয়েছিলেন আরো অনেকদিন । তারপর একদিন এক বড্ড বিষণ্ণ সন্ধ্যায় তিনি বুঝতে পারেন , তার ছোট ছেলের গানের গলা আর বাউক্কা ব্যাঙের ডাকের মাঝে তেমন বিশেষ কোন ফারাক নেই । সেইদিনই হারমোনিয়ামটি আমার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায় । অবশ্য যতোই বড় হয়েছেন , আমার মা তার ভুল বুঝতে পেরেছে্ন । বাউক্কা ব্যাঙ নয় বরং ভেড়ার সাথেই যে আমার কন্ঠের সাদৃশ্য বেশি এই ব্যাপারে এখন তিনি নিসন্দেহ ।
এইভাবে যখন গান শেখার বিশাল যজ্ঞে আমি যখন অত্যন্ত সুদক্ষভাবে পানি ঢেলে দিলাম তখন মা সত্যিই ভাবনায় পড়ে গেলেন । অনেক ভেবেচিন্তে তিনি একদিন সকালবেলা আমাকে বগলদাবা করে চট্টগ্রাম শিশু একাডেমীতে নিয়ে গেলেন । সেখানে চিত্রাঙ্কন বিভাগে ভর্তি করিয়ে দিলেন । প্রতি সপ্তাহের শুক্র আর শনি দুইদিন করে ক্লাস । যাইহোক পরের সপ্তাহের শুক্রবারে প্রথম ক্লাস ।
প্রথম দিন ক্লাসে গিয়ে আমি হতবাক । আমার তখন কেবল দুইটা ফুলপ্যান্ট ; তাও প্রচন্ড শীতের জন্য তুলে রাখা । এছাড়া সারা বছর কাটে হাফপ্যান্টেই ; সদ্য ক্লাস ওয়ানে ওঠা একটা ছেলের জন্য সেটাই স্বাভাবিক । ঐ ক্লাসরুমে আমি ছাড়া আর কারো পরনেই হাফ প্যান্ট নেই । উচ্চতায় সবাই আমার প্রায় দ্বিগুণ । মা যে এবার আমাকে ভালোই টাইট দেয়ার বন্দোবস্ত করেছেন সেটা ভালোই বুঝতে পারছিলাম । ক্লাসে চেয়ার-টেবিল বলতে কিছু নেই । মাটিতে লাল রঙের দড়ির কার্পেট বিছানো । ওখানে বসেই ছবি আঁকতে হবে । ক্লাসের পিছনের দিকের এক কোণায় জড়োসড়ো হয়ে বসলাম । লোকে ক্লাসরুমে কলম হারায় , পেন্সিল হারায় , ইরেজার হারায় – আর আমি প্রথম দিনেই হারিয়ে এসেছিলাম আমার গোটা ব্যাগটা । কিভাবে হারিয়েছিলাম সেটা আর এখন মনে নাই । তবে যেটা মনে আছে সেদিন ড্রইং ক্লাস শেষেই বাসায় এসে ইনিয়ে-বিনিয়ে থেকে শুরু করে রীতিমতো তারস্বরে কান্না জুড়ে দিয়েছিলাম আর সেখানে ফেরত না যাওয়ার জন্য । কিন্তু কে শোনে কার কথা ! পরদিন শনিবার দুপুরে আমি আবার নিজেকে আবিষ্কার করি সেই বিশাল ক্লাসরুমে আমার চেয়ে দ্বিগুণ আকৃতির ছেলেমেয়েদের সাথে ।
সেদিন ক্লাসশেষে বের হয়ে যাচ্ছি । এমন সময় আমার বয়সী একটা ছেলে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করল
--তুমি কি দুর্জয় ?
-- হুম । কেন ?
--তোমার কি ব্যাগ হারিয়ে গিয়েছে ?
--হ্যাঁ । কিন্তু কেন ?
--ব্যাগটা আমার কাছে আছে ।
এই বলে ছেলেটা তার ছোটখাটো পেটটা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসতে লাগলো । আমার হারানো ব্যাগ তার কাছে আছে – এতে এতো হাসির কি হল বুঝতে পারছিলাম না । আমি ছেলেটার দিকে ভালো করে তাকালাম । টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ । উচ্চতায় আমার চেয়ে কম , চোখে কার্বন ফ্রেমের গোল চশমা । পেটটা একটু ফোলা , মাথার চুলের অধিকাংশই খাড়া খাড়া ।
--এই নাও তোমার ব্যাগ ।
-- তুমি বুঝলে কি করে আমিই দুর্জয় ?
--বা রে ! ব্যাগের ভিতর তোমার ড্রইং খাতা ছিল তো । তাতে তোমার নাম আর কোন ক্লাসে পড় সেটা লেখা ছিল । এখানে যারা আছে তাদের মধ্যে তুমি ছাড়া আর কেউ ক্লাস ওয়ানে পড়ার মতো ছোট নাই ।
এটুকু বলেই ছেলেটা আবার পেট দুলিয়ে দুলিয়ে হাসতে লাগলো । আমি ব্যাগের ভিতর উঁকি দিলাম সব ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য । এমন সময় ছেলেটা আবার বলল ,
--নীল রঙটা ওখানে নাই ।
আমি আমার ওয়াটার কালার বক্স খুলে দেখলাম আসলেই সেখানে নীল রঙের টিউবটা নেই । আমি প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই সে আবার বলল ,
--কাল রাতে ছবি আঁকার সময় আমার নীল রঙটা শেষ হয়ে গিয়েছিল । তাই তোমারটা ব্যবহার করে ফেলেছি ।
বলেই এবার জিভ কাটলো ।
--আর কিছু নিয়েছো ?
-- হ্যাঁ নিয়েছি তো । একটা চকোলেট ছিল সেটা খেয়ে ফেলেছি । আর ইরেজারটা বাসায় ব্যবহার করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছি ।
--এভাবে অন্যের জিনিস ব্যবহার করা কিংবা হারানো উচিত না –এটা তুমি জানো না ?
--বা রে! আমি গতকাল ব্যাগটা না নিয়ে গেলে তুমি তো আজ খুঁজেই পেতে না ।
এই বলে সে একটা ভেংচি কেটে পেটটা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসতে লাগলো । এভাবেই অয়নের সাথে পরিচয়। শহরের অন্য প্রান্তের একটা স্কুলে ক্লাস ওয়ানে পড়ে । প্রথম দিন তাকে খুঁজে না পাওয়ার কারণ ছিল সেও নাকি একটা কোণায় আমার মতো চুপচাপ বসে ছিল । পরের সপ্তাহে আমি আর অয়ন মিলে গোটা ক্লাসরুম খুঁজে দেখলাম আমার বয়সী আর কেউ আছে কি না । না , ছিল না । একটা ড্রইং ক্লাসের সর্বকনিষ্ঠ দুই বালকের বন্ধুত্বের শুরু এভাবেই ।
ছবি আঁকার বিভিন্ন রকমের মাধ্যম আছে । একাডেমীর তিনটা বছরে আমাদের তিনটা মাধ্যমের সাথে পরিচয় ঘটানো হয়েছিল – স্কেচ ,প্যাস্টেল কালার আর জলরং । শুরুটা হয়েছিল প্যাস্টেল কালার দিয়ে । ক্লাসের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে চুরাশি কিংবা একশ রঙের প্যাস্টেল বক্স নিয়ে আসতো , কিংবা নিদেনপক্ষে চৌষট্টি রঙের । আমার বাবা- মা’র বারোর বেশি সাধ্য ছিল না , অয়নেরও তাই । তাই দুজন মিলে প্রতিদিন ইচ্ছেমতোন রঙ বানাতাম । একটা রঙের উপর আরেকটা ঘষে দিতাম , আর অবাক হয়ে দেখতাম তৃতীয় রঙের সৃষ্টি । আসলে বয়সটাই অবাক হওয়ার পক্ষে সাফাই গাইতো ।
সে সময় একা একা বাইরে বের হওয়ার অনুমতি ছিল না । আমি আর অয়ন দুজনেই ক্লাস শেষে নিজেদের বাবা কিংবা মায়ের জন্য অপেক্ষা করতাম আর প্রায় প্রতিদিনই তাদের দেরী হতো । দুইজন একসাথে থাকলে সাহস বেড়ে যেতো অনেকটাই । তাই ছুটি হওয়ার পর একাডেমী চত্বর থেকে বাইরে বের হওয়ার নিষেধোজ্ঞা বেমালুম ভুলে যেতে লাগলাম । ছুটির পর আমি আর অয়ন রোজ আশেপাশের এলাকাটায় ঘুরে বেড়াতাম । এই ঘুরতে ঘুরতে একদিন আমাদের সাথে সেই গাছঘরের খোঁজ পাওয়া ।
গাছঘরটা ছিল প্রবর্তক মোড়ে । একটা পুরাতন হলদে রঙের বাড়ি , তার মাঝে লাল ইটের বিস্তৃতি । বাড়িটার গেইটটা সব সময় বন্ধ থাকতো । আমরা কখনোই কাউকে সেখানে ঢুকতে কিংবা সেখান থেকে বের হতে দেখি নি । গেইটের সামনের নামফলকে কোন নাম দেয়া ছিল না । তাই আমরা এর নাম দিই ‘গাছঘর’ । নামটা আমি নাকি অয়ন দিয়েছিলাম এখন আর সেটা মনে পড়ে না । তবে নামকরণের কারণটা মনে পড়ে । বাড়িটার সারা দেয়ালজুড়ে মোটা আস্তর জমেছিল শ্যাওলার , ছাদ থেকে নেমে এসেছিল বিশাল লম্বা গাছের লতা । গেটের গ্রিলের মধ্য দিয়ে কিংবা এর উপর লাফিয়ে যতোটা চোখ যেতো চোখে পড়তো বাড়িটার সামনে বিশাল একটা অংশ জুড়ে সবুজ রঙের পানি জমে আছে । আর যেটুকু শুকনো ছিল সেটাও ছিল ঘাসে ভরা । এই বাড়ির নাম ‘গাছঘর’ ভিন্ন অন্যকিছু হওয়ার সুযোগ ছিল না আমাদের কাছে ।
একাডেমীতে বিভিন্ন দিন বিভিন্ন বিষয়ের ছবি আঁকা শেখানো হতো । ২য় বর্ষের মাঝামাঝি এসে নির্ধারিত হল মাসের শেষ শুক্রবার আমরা যে যার খুশিমতো আঁকতে পারবো । অয়ন আর আমি প্রথম ক্লাসেই আঁকলাম গাছঘরের ছবি । যিনি আমাদের ছবি আঁকা শেখাতেন তিনি বেশ অবাক হয়ে গেলেন এই ঘটনায় । এর পরের সপ্তাহে একদিন হঠাৎ আমরা আবিষ্কার করি , আমাদের গাছঘরের মেইন গেইটটা হাঁ করে খোলা । সেদিন সাহস করে বাড়িটার ভিতরের আঙিনায় ঢুকে গিয়েছিলাম দুজনেই । এদিক-ওদিক ভালোমতো লক্ষ করেও কোন জনমানুষের চিহ্ন পাই নি খুঁজে ।
গাছঘর নিয়ে আমাদের এই সাহসী অ্যাডভেঞ্চার বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে যে দাঁড়াতো সেটা বলা মুশকিল হতো যদি আকস্মিক একটা বাধা এসে আমাদের সামনে না পড়তো । একাডেমীতে ৩য় বর্ষে ওঠার পর সব ছাত্র-ছাত্রীদের দুইভাগে ভাগ করে দেওয়া হয় । একভাগ সকালে ক্লাস করবে , আরেক ভাগ বিকালে । আমাকে দেওয়া হয় সকালের ক্লাসে আর অয়নকে পাঠিয়ে দেয়া হয় বিকালেরটাতে । এরপর আমাদের দেখা হওয়ার পরিমাণ কমতে থাকে । তখন ফোন এখনকার মতো সহজলভ্য কিছু ছিল না । তাই যোগাযোগ একেবারে প্রায় বন্ধই হয়ে গেলো । একাডেমীর ক্লাস শেষে আমি এদিক-ওদিক হাঁটি ; প্রায়সময়ই সেই গাছঘরটার দিকে যাই । গ্রিলের ফাঁক দিয়ে মুখ ঢুকিয়ে ভিতরের দিকে তাকাই । কিন্তু একা একা ভালো লাগে না কিছুই ।
এভাবেই একদিন একাডেমীর ক্লাস শেষ হয় । ফাইনাল পরীক্ষার সময়সূচী দেয়া হয় এবং সেখানে বলা হয় সকাল এবং বিকালের সকল ছাত্র-ছাত্রীর পরীক্ষা একাসাথে হবে । অর্থাৎ অয়নের সাথে দেখা হওয়ার ভালো একটা সুযোগ পাওয়া গেলো । সর্বমোট চারটা পরীক্ষা । প্রথম তিনটা পরীক্ষা দেয়ার পর যথারীতি আমরা ঘুরে বেড়ালাম ; আমাদের সেই গাছঘরটার দিকেও গেলাম । কিন্তু বিপত্তি বাধলো শেষ পরীক্ষার দিন । সেদিন পরীক্ষা দিতে দিতেই অয়ন হুট করে পেটে প্রচন্ড ব্যাথা বোধ করতে লাগলো । তার সেই যন্ত্রণাকাতর চেহারাটা এখনো মনের মধ্যে গেঁথে আছে । খবর পেয়ে অয়নের বাবা এলো তাকে নিতে । সেটাই ছিল অয়নকে আমার শেষবারের মতো দেখা । এরপর অয়নের সাথে আর কখনো দেখা হয় নি । এমনকি যেদিন একাডেমী থেকে আমাদের সার্টিফিকেট দেয়া হচ্ছিল সেদিনও না ।
এর বছর তিনেক বাদে একটা আর্ট কম্পিটিশনে এক বড় ভাইয়ার সাথে দেখা হয় । উনি একাডেমীতে আমাদের সাথে ছবি আঁকা শিখতেন । উনি আর অয়ন একই স্কুলেই পড়তেন যদিও উনি ছিলেন ছয় ক্লাস উপরে । সেই ভাইয়াকে অয়নের কথা জিজ্ঞাসা করায় জানতে পারলাম অয়নের পেটে নাকি টিউমার হয়েছিল এবং সেটা ধরা পড়তে যথেষ্ট দেরী হয়ে গিয়েছিল । এদেশের চিকিৎসায় ভালো ফলাফল না আসায় অয়নকে নিয়ে তার বাবা-মা পাশের দেশে গিয়েছিলেন । এর বেশী আর তিনি জানেন না । খবর নেওয়ার চেষ্টা করেও পান নি । তবে শেষবারে অয়নকে যে অবস্থায় দেখেছিলেন ,সেটা নাকি ছিল ভয়ানক ! এদেশের ডাক্তাররা একরকম শেষ কথা বলেই দিয়েছিল । আর অয়ন বেঁচে থাকলে কিংবা দেশে ফিরে এলে তিনি নিশ্চিত খবর পেতেন ।
এর বছর তিনেক বাদে একটা আর্ট কম্পিটিশনে এক বড় ভাইয়ার সাথে দেখা হয় । উনি একাডেমীতে আমাদের সাথে ছবি আঁকা শিখতেন । উনি আর অয়ন একই স্কুলেই পড়তেন যদিও উনি ছিলেন ছয় ক্লাস উপরে । সেই ভাইয়াকে অয়নের কথা জিজ্ঞাসা করায় জানতে পারলাম অয়নের পেটে নাকি টিউমার হয়েছিল এবং সেটা ধরা পড়তে যথেষ্ট দেরী হয়ে গিয়েছিল । এদেশের চিকিৎসায় ভালো ফলাফল না আসায় অয়নকে নিয়ে তার বাবা-মা পাশের দেশে গিয়েছিলেন । এর বেশী আর তিনি জানেন না । খবর নেওয়ার চেষ্টা করেও পান নি । তবে শেষবারে অয়নকে যে অবস্থায় দেখেছিলেন ,সেটা নাকি ছিল ভয়ানক ! এদেশের ডাক্তাররা একরকম শেষ কথা বলেই দিয়েছিল । আর অয়ন বেঁচে থাকলে কিংবা দেশে ফিরে এলে তিনি নিশ্চিত খবর পেতেন ।
মন খারাপ ব্যাপারটার সাথে মনে হয় সেদিনই আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল । কম্পিটিশন থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গিয়েছিলাম আমার আর অয়নের বহুপ্রিয় সেই গাছঘরটার কাছে । বাড়িটা তখনো আগের মতোই ছিল – সবুজে ঘেরা , নির্জন ।
এখন আমি বেশ অনেকটাই বড় । আমার শহরটাও বড় হয়েছে ভালোই । শহরের এই বড় হওয়ার বাঁকে ভেঙে গিয়েছে বহু প্রাচীন ভবন । বাতাসকে ফেরারী করে শহরের আকাশের অনেকটাই দখল করে নিয়েছে উঁচু উঁচু বিল্ডিং । আমার আর অয়নের গাছঘরটাও বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছে এই বড় শহরটায় মানিয়ে নিতে না পেরে । গাছঘরটা নেই কিন্তু সেই জায়গাটা তো আছে এখনো । সময় পেলেই যাই ওদিকটায় । চুপচাপ চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি । আমার কাছে আমার শৈশব তার একমাত্র বন্ধুর গন্ধ নিয়ে হাজির হয় ।
অয়নের কোন খোঁজ এখনো পাই নি । হয়তো আর কখনো পাবোও না । তবে আমার ভাবতে ভালো লাগে – অয়ন এখন বেশ বড়সড় একটা মানুষ হয়ে গিয়েছে । মাথার চুলগুলো এখন ঠিকমতো আঁচড়াতে পারে সে । এই শহর থেকে একটু দূরে বিশাল একটা গাছঘর বানিয়ে বসে আছে আমার অপেক্ষায় । আমি পৌঁছালেই সেই প্রথম দিনের মতো পেট দুলিয়ে দুলিয়ে হাসতে শুরু করবে !
এখন কেবল সেই গাছঘরের খোঁজ পাওয়ার অপেক্ষা !
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন