সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

শ্রাবনী

শ্রাবনী
ভেজা ভেজা ঠাণ্ডা বাতাসে কেঁপে উঠলো নোবেল। বাস থেকে নেমেই বুঝতে পারলো আজ রাতে জোস একটা ঘুম হবে। ছোট্ট ব্যাগটা হাতে নিয়ে বাড়ীর পথে দ্রুত পায়ে এগুলো সে। বৃষ্টি আসার আগেই বাসায় পৌছাতে হবে। ছেলেদের একটা বয়স থাকে, যখন তাদের মধ্যে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সিক্সথ সেন্স জিনিশটা কাজ করে। তা না হলে রাস্তার মোড়ের বিশাল পাঁচতলা বাড়ীটার টপ ফ্লোরের বারান্দায় তার চোখ পড়ার কোন কারণ থাকতে পারেনা। শ্রাবণী, এটা অবশ্যই শ্রাবণী। অজান্তেই থেমে যায় নোবেল। এখনো মোবাইল ফোন জিনিশটা এতো চালু হয়নি, শ্রাবণীর মোবাইল নেই, কি করে ডাকবে সে শ্রাবণীকে? আর শ্রাবণী এখানেই বা এলো কি করে? ওর তো এখন ভার্সিটিতে থাকার কথা। শ্রাবণীর শেষ চিঠিটা পেয়েছিলো সে দুদিন আগেই, তখনো সে হলেই ছিল। অসহায় ভাবে এদিক সেদিক তাকায় নোবেল। বাতাসের যা শব্দ,নীচ থেকে চিৎকার করে ডাকলেও শ্রাবণী তার ডাক শুনতে পাবে না কোন ভাবেই।
চিৎকার করে শ্রাবণী বলে ডেকে ওঠে সে। একবার, দুবার, তিনবার। শ্রাবণী শুনতে পায় না। মাথা ঘুরিয়ে অন্ধকার হয়ে আসা আকাশের দিকে দেখে নোবেল। আবার হাটতে শুরু করে বাসার দিকে।
- - - - -
“কি রে, তুই হঠাৎ, কোন খবর না দিয়ে” অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন মা। “ভাল লাগছিলনা, চলে এলাম” দায়সারা একটা জবাব দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো নোবেল। কাপড় ছেড়ে অনেকক্ষন ধরে গোসল করল সে। চুল মুছতে মুছতে মিউজিক সেন্টার চালু করলো, “শাওন রাতে যদি, স্মরণে আসে মোরে”, গতবার যাবার আগে এই গানটাই শুনেছিল সে, আজ সন্ধ্যা মিলিয়ে যাওয়া এই বৃষ্টি ভেজা সময়টাতে যেন তার কল্পনার সঙ্গী হতেই আবার বেজে উঠলো সেই গানটা।
ঘুম না হওয়া লাল চোখ নিয়ে নোবেল যখন বি.সি.এস.আই.আর সেমিনার রুমে পৌছালো, তখনো সেমিনার শুরু হতে বিশ মিনিট বাকি। ঝটপট গত ছয় মাসে তৈরি করা পেপারটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলো নোবেল। আজকের প্রেজেন্টেশনের উপর নির্ভর করছে তার ভবিষ্যৎ। স্কলারশিপটা পেয়ে গেলে তাকে সম্ভবত জীবনে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। শ্রাবণীর ফ্যামিলির কাছেও নিজেকে যোগ্য বলে প্রমাণ করতে পারবে সে, তাদের বিয়েতে আর কোন বাধা থাকবেনা।
সেমিনার শেষ হতে হতে বিকেল হয়ে গেছে। বাইরে বেড়িয়েই স্কুটার ডাকল নোবেল, বাসায় যাবার তর সইছেনা তার। কিন্তু সবার আগে যদি শ্রাবণীকে জানাতে পারতো সুখবরটা। তার স্কলারশিপটা হয়ে গেছে। আর মাত্র তিন মাস বাকি, এর মধ্যেই তাকে গুছিয়ে নিতে হবে সবকিছু, সবকিছুই। পৃথিবীটা আজ নতুন লাগছে নোবেলের কাছে। অফিস ফেরত মানুষের ভিড়ে তৈরি হওয়া জ্যাম আজকের মত এত অসহনীয় লাগেনি কোনদিন। স্কুটারের কেন পাখা থাকেনা?
চারিদিক ঝিকমিক করছে আলোয়। পাঁচতালাটা আজ সেজেছে নতুন সাজে। বাসার মোড়ে পৌঁছেই নোবেলের সব আনন্দ মাটি হয়ে গেছে। ভয়ঙ্কর একটা আশঙ্কায় কেঁপে উঠেছে সে। তবে কি ... ... ? এই কারণেই কি শ্রাবণীর ঢাকায় আসা? পাঁচতলায় কি শ্রাবণীর কোন রিলেটিভের বাসা? ভাল ছেলে পেলে অনেকেই মেয়ে ঢাকায় নিয়ে এসে বিয়ে দিয়ে দেন। নাহ, সে আর কিছুই ভাবতে পারছেনা।
তাকে দেখেই মা ধরে নিয়েছেন যে তার স্কলারশিপটা হয়নি। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে চুপ করে শুয়ে আছে সে। তার এত দিনের সাজানো পৃথিবী, নিজ হাতে গড়া শত শত স্বপ্ন আর কোন দিন পূরণ হবে না। কি করবে সে এই স্কলারশিপটা দিয়ে, কি করবে বিদেশে গিয়ে? শ্রাবণী ছাড়া তার এই সবের কোন দাম আছে?
বাজী ফোটার প্রচণ্ড শব্দে যেন বাস্তবে ফিরে আসে নোবেল। আচ্ছা, বিয়ে তো শ্রাবণীর নাও হতে পারে। হয়তো কোন কাজিনের, অথবা অন্য কোন ফ্লাটের কারো। হয়তে খামখাই সে চিন্তা করছে। মুহূর্তে ভাল হয়ে যায় মন। দরজায় টোকা দেন মা। এক লাফে উঠে দরজা খোলে সে। “ আমি আর তোমার বাবা একটু বাইরে যাচ্ছি, তুমি বাসায় থাকো, আমার ফিরতে দেরি হবে ” মা বললেন। কথা না বারিয়ে মা কে সালাম করে নোবেল “ মা, আমার স্কলারশিপটা হয়ে গেছে ”। দুহাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন মা। চুমু খান কপালে। “এতক্ষণ বলিসনি কেন? আমি তো তোর চোখমুখ দেখে ভাবলাম স্কলারশিপটা বুঝি হয়নি, যা, তোর বাবাকে সালাম করে আয়”। মমতাময়ীর চোখে পানি।
আলোকিত চোখমুখ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন মা বাবা, দরজা বন্ধ করে খাবার টেবিলের কাছে এগিয়ে যায় নোবেল। এক গ্লাস পানি খেয়ে নিজের ঘরের দিকে রওনা দেয়। চোখে পড়ে একটা বিয়ের কার্ড, টেবিলের ওপর রাখা। খামের উপর প্রেরকের ঠিকানায় সেই দশতলা বাড়ীর নাম লিখা। হৃৎপিণ্ডের অবস্থান এখন নোবেলের গলার খুব কাছে। দ্রুত হাতে খাম থেকে বের করে কার্ডটা, সুন্দর হরফে লিখা বধূর নামের উপর চোখ আটকে যায়। এই নামটা নোবেলের খুব পরিচিত।
"শামিমা আক্তার চৈতী" - শ্রাবণীর বান্ধবী, রুমমেট।
পরদিন সকালে একটু দেরি করেই ঘুম থেকে ওঠে নোবেল। নাস্তা করে বেড়িয়ে পরে, মাথায় একটাই চিন্তা, কি করে শ্রাবণীর সাথে দেখা করা যায়। একবার মনে করে, সোজা ওই বাসায় গিয়ে হাজির হবে। তার আগে একবার ফোনে ট্রাই করে দেখবে নাকি?
বের হবার আগেই ফোন নম্বরটা টুকে নিয়েছিল সে। হাজারটা চিন্তা মাথায় নিয়ে রাস্তার মোড়ের দোকানে গিয়ে হাজির হয় নোবেল। অপলক তাকিয়ে থেকে দশতলার বারান্দাটার দিকে, কিন্তু শ্রাবণী আর সেই বারান্দায় এসে দাড়ায় না। একে একে নোবেলের বন্ধুরা এসে হাজির হয়, গল্পে গল্পে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়।
সন্ধ্যাবেলায় হঠাৎ করেই একটা সুযোগ পেয়ে যায় নোবেল। মা বাবা যাবেন চৈতীর বৌভাতে, মা কে অবাক করে দিয়ে তাদের সাথী হয় নোবেল। কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছেই তার চোখ খুঁজতে থাকে শ্রাবণীকে, এক সময় পেয়েও যায়। অসম্ভব সুন্দর লাগছে আজ শ্রাবণীকে, চারপাশের সব মেয়েকে ম্লান করে দিয়ে যেন হীরের মত জ্বলছে মেয়েটা। ঠিক কতক্ষণ শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে ছিল সে জানেনা, তার সম্বিত ফিরে আসে যখন একটা ছেলে তার কাছে এসে বলে “ভাইয়া, চৈতী আপু আপনাকে স্টেজে ডাকছেন”। ধীর পায়ে স্টেজের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় নোবেল, চৈতী তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় অনেকের সাথেই, এক ফাঁকে নোবেল বলে ফেলে তার স্কলারশিপের কথাটা। তাকে কনগ্রাচুলেট করে পাশে দাঁড়ানো সবাই। চৈতীর চোখে হঠাৎ দুষ্টুমির ঝিলিক দেখে সচকিত হয় নোবেল, সেই মুহূর্তে পিঠে একটা চিমটি অনুভব করে বুঝতে পারে শ্রাবণী এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। চৈতী শ্রাবণীর
সাথেও পরিচয় করিয়ে দেয় নোবেলকে, “শ্রাবণী, এ হচ্ছে নোবেল - আমার বন্ধু, আর নোবেল, ইনি হচ্ছেন আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী শ্রাবণী”। চৈতীর দুষ্টুমি তখনো শেষ হয়নি। শ্রাবণীকে লজ্জায় লাল করে দিতেই বুঝি ওদের দুজনকে নতুন করে তার বরের সাথে পরিচিত করে দেয় চৈতী, বলে “ইনারা হচ্ছেন মিস্টার এন্ড মিসেস নোবেল”। চৈতীর কথায় লজ্জা পেয়ে যায় নোবেল নিজেও।
বৌভাতের ব্যস্ততা শেষ করে ক্লান্ত শ্রাবণীকে একটু একা পেয়ে আগামী দিনের প্লানটা করে ফেলে নোবেল।
মেয়েদের কিছু জিনিস কখনই বুঝতে পারেনা নোবেল। নিউ মার্কেটে যেতে স্কুটার নেয়াই পছন্দ করে সে, কিন্তু শ্রাবণীর কথায় রিক্সা নিতে হয় তাকে। রিক্সায় উঠেই তার মনে হয় আজকের দিনটাই অন্যরকম। টুকটাক কথার ফাকে ফাকে শ্রাবণীকে অনেকবার ধন্যবাদ দেয় সে মনে মনে। দুজন মিলে রিক্সায় চড়ার মজাটা স্কুটারে পাওয়া যেতো না।
মার্কেটে মেয়েদের সাথে যাওয়াটা সবসময়েই বিরক্তিকর লাগতো নোবেলের। কিন্তু আজকে শ্রাবণীর চেয়ে তাকেই দোকানে দোকানে বেশী ঘুরতে দেখা গেল। শ্রাবণীও যেন একটু বদলে গেছে আজকে। বিয়ের আগেই নিজেকে যেন বউ বউ লাগছে তার, লজ্জাও পাচ্ছে একটু একটু। তাদের এত দিনের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে আর দুমাসের মধ্যেই।
দুপুরে লাঞ্চ করে শ্রাবণীকে নিয়ে ধানমন্ডি লেকের ধার ঘেঁসে হাঁটছে নোবেল। এত ঘোরাঘুরির পরেও আজ একটুও ক্লান্ত লাগছেনা কারোই। কেন যেন ওরা আজ ফিরে গেছে পুরনো দিনগুলোতে। সেই প্রথম পেন ফ্রেন্ডশিপ করতে গিয়ে পরিচয়, তারপর প্রেম, প্রথমবার দেখা করার অনুভূতি, মজার সব গল্পে কাটছে সময়টা। বাসায় ফেরার জন্য রিক্সা নিতে যাবে ওরা, এমন সময় ওদের প্রায় গা ঘেঁষে থামল একটা ঝকঝকে নীল টয়োটা। গাড়ী থেকে বেড়িয়ে এলো সানগ্লাস পড়া এক তরুণ। “শোয়েব ভাই” – শ্রাবণীর গলায় উচ্ছ্বাস। এক ছুটে শ্রাবণী গিয়ে দাঁড়ালো ছেলেটার মুখোমুখি। শ্রাবণীর চোখেমুখে অদ্ভুত এক আলো লক্ষ্য করে মনটা একটু খারাপই হয়ে গেল নোবেলের। দশ মিনিট পেরিয়ে যাবার পরেও শ্রাবণী যখন একবারের জন্যেও ফিরে তাকালোনা তার দিকে, তখন মন খারাপ ভাবটা অভিমানের রূপ নিতে লাগলো।
তারও কিছুক্ষণ পর শ্রাবণী হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো নোবেলকে। পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বললো “এ হচ্ছে নোবেল, আমার বন্ধু, নোবেল চলো, শোয়েব ভাই আমাদেরকে বাসায় নামিয়ে দেবেন”। নীল টয়োটার পেছনের সীটে একা বসে থেকে নোবেলের অভিমানটা ক্রমেই গাড় হতে লাগলো। বাসার কাছে এসে পথেই নেমে পড়লো নোবেল, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখল সে।
নোবেল বাসায় ঢুকেই ফ্রেস হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। অভিমান জিনিসটা খুব খারাপ। মানুষ রাগের মাথায় যে কাজটা করতে পারে না, অভিমান করে তা অনায়াসে করতে পারে। সে ভেবেছিলো আজই মা কে বলবে শ্রাবণীর কথা। আগামীকাল শ্রাবণীকে নিয়ে আসবে তাদের বাসায়। মা কে কিছুই না বলে ঘুমিয়ে পড়লো নোবেল। ঘুম ভাঙল অনেক রাতে। ভাত খেয়ে বারান্দায় ইজি চেয়ারটা টেনে বসলো সে। হঠাৎ করেই মন খারাপ ভাবটা কেটে গেল তার। নিজের মনেই হেসে উঠলো সে। মনে মনে বললো “নোবেল, তুমি কি জেলাস?” শ্রাবণী তাকে ভালবাসে, এর চাইতে বড় সত্য আর কিছু কি আছে? শ্রাবনীওতো একটা মানুষ, তারও তো ফ্যামিলি আছে, দায়বধ্যতা আছে, সমাজ আছে। নিশ্চয় এমন কনো কারণ ছিল যার জন্যে শ্রাবণী তাকে সে ভাবে প্রেজেন্ট করতে বাধ্য হয়েছে। শ্রাবণীর জন্যে আবারো ভালবাসায় বুকটা ভরে ওঠে নোবেলের। মনে হতে থাকে – এই মুহূর্তে শ্রাবণীকে না দেখলে আর চলবেনা তার। ব্যাগ থেকে শ্রাবণীর ছবিটা বের করে অনেক বার তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয় নোবেল।
পরদিন শ্রাবণীকে নিয়ে চারুকলায় এক্সিবিশন দেখতে যাবে বলে সকাল সকাল বেড়িয়ে পরে নোবেল। নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে মনে মনে আজকে কি কি বলবে শ্রাবণীকে, তার একটা ছক করতে থাকে নোবেল। দশটায় আসার কথা শ্রাবণীর। সাড়ে দশটার দিকে শ্রাবণীকে দেখা যায় সেই নীল টয়োটায়। গাড়ী থেকে নেমে এসে শ্রাবণী বলে “আমি শোয়েব ভাই এর সাথে একটু কুমিল্লায় যাচ্ছি, তুমি আজ বাসায় চলে যাও, আমাদের ফিরতে দেরি হবে, কিছু মনে কর না প্লিজ। আর আমি কাল বাসাই ফিরে যাচ্ছিনা, আর দুই তিন দিন থাকবো, পরে কথা হবে, ঠিক আছে?”।
ওরা চলে যাবার পরেও কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে নোবেল। তারপর বাসায় এসে ব্যাগ গুছিয়ে সোজা চলে যায় বাস স্ট্যান্ডে, টিকেট কেটে সেদিন সন্ধ্যা বেলাতেই ফিরে আসে তার হলে।
- - - - - - -
নীলয় ঘুমিয়ে ছিল। সকাল সাতটা বাজে মাত্র। এমন সময় নোবেল গিয়ে তার ঘুম ভাঙ্গাল। কড়া গলায় একটা ঝারি দিতে গিয়েও থেমে গেল নীলয়। নোবেলের চোখমুখ ফোলা ফোলা, রাতে এক ফোটা ঘুমায়নি, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ক্যান্টিনে নাস্তার অর্ডার দিয়ে নোবেলকে নিয়ে এক কোণায় বসলো নীলয়। এটা সেটা কথা বলতে বলতে নাস্তা শেষ করলো ওরা। কেন তার মন খারাপ, এটা নিয়ে একটা কথাও বলেনি নোবেল, কিন্তু নীলয় জানে এক সময় ঠিকই সব কিছু বলবে সে, না হলে এতো সকালে তার কাছে আসতো না। নোবেলকে সেই সুযোগটা করে দিতেই নীলয় তাকে নিয়ে গিয়ে বসলো বড় দিঘীটার পাশে। অনেকক্ষন দিঘীর জলের দিকে তাকিয়ে থেকে এক সময় নীলয়কে সব কিছু বলে গেলো নোবেল।
“সত্যি কি তুই ভালবাসিস শ্রাবনীকে?” প্রশ্ন করে নীলয়। “বাসি দেখেই তো কষ্ট পাই” যেন অন্ধকার কোন কূপ থেকে উঠে আসছে নোবেলের কথা গুলো। “তাহলে এই সামান্য কারণে তুই ঢাকা ছাড়লি কেন?” কোন উত্তর পাবেনা জেনেও প্রশ্নটা করলো নীলয়। “দেখ নোবেল, প্রথমত তুই একটা বোকামি করেছিস ঢাকা ছেড়ে, আরেকটা বোকামি করেছিস খালাম্মাকে শ্রাবণীর কথাটা না বলে। এখন তুই তোর নিজের সাথে বুঝে দেখ, যদি তুই সত্যি শ্রাবনীকে ভালবেসে থাকিস, সত্যি যদি তুই বিয়ে করতে চাস তাকে, তাহলে এখনও সময় আছে তোর ভুল গুলো শুধরে নেবার“ একটানা কথা বলে থামল নীলয়। আরও কিছুক্ষণ কথা বলে উঠলো ওরা, রুমে ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে গেল। নোবেলকে ঢাকার বাসে তুলে দিয়ে হলে ফিরে গেলো নীলয়, তার আগে
দুইটা জরুরী ফোন কল সেরে নিলো।
অনেক রাতে বাসায় ফিরে এলো নোবেল। পরদিন সকালে উঠেই গিয়ে দাঁড়ালো সেই জায়গাটায়, যেখানে শ্রাবণীর সাথে দেখা করে সে। অপেক্ষার প্রহর কেটে যায়, কিন্তু শ্রাবণী আসেনা। দুপুরবেলা মন খারাপ করে ঘরে ফেরে নোবেল। বিকেলে আবার গিয়ে বসে সেই জায়গাটাতে, কথা বললো বন্ধুদের সাথে, শ্রাবণীর সাথে দেখা হয়না।
- - - - - - -
পরদিন সকালে আবার সেই একই জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায় নোবেল। “আরে, নোবেল যে, কেমন আছেন” কখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে নীল টয়োটা, খেয়ালই করেনি নোবেল।
চমকে ওঠে সে শোয়েবের কথা শুনে। সৌজন্য বিনিময়ের পর শোয়েব বললো “শ্রাবনীকে বাসে তুলে দিয়ে এলাম, ওর বাসা থেকে ডেকে পাঠিয়েছে হঠাৎ করেই”। বলেই চোখ টিপলো। তারপর নোবেলের অবাক দৃষ্টি অনুসরণ করে আবার বললো “আরে ভাই, বিয়ে শাদির ব্যাপার, শ্রাবণী নিজেও জানেনা অবশ্য, কিন্তু আমি জানি। আপনার বান্ধবী খুব শিঘ্রী বিয়ের পিড়িতে বসতে যাচ্ছে”। যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে হালকা কিছু রসিকতা করে শোয়েবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ীর পথ ধরল নোবেল।
কেন মানুষের জীবনটা এমন হয়? শ্রাবনীকে সে ভালবাসে, অনেক ভালবাসে, কিন্তু সেই শ্রাবণী যদি তার জীবনে না থাকে, তা হলে কি করে একা একা বাঁচবে সে? এতদিন পর যখন তাদের সাজানো স্বপ্নটা সত্যি হতে যাচ্ছে, তখনি কি এমন হতে হবে? পৃথিবী এত নিষ্ঠুর কেন? ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পরে নোবেল। দুপুরে উঠে সোজা চলে আসে হলে।
- - - - - - -
নীলয়ের বিছানা ফাকা, ঘণ্টা খানেক সেই বিছানায় চুপচাপ শুয়ে থেকে নোবেল, গান শোনে। নীলয়কে সে ঠিক বুঝতে পারেনা কখনই। এই ছেলেটা সবার বন্ধু, সবাই তাকে ভালবাসে, কিন্তু কেউই তার খুব কাছে যেতে পারেনা। সে রুমে নেই, কোথায় গেছে, কখন আসবে – কেউ জানেনা। নোবেল কেন তার জন্য বসে আছে, তাও জানেনা। শুধু জানে, এই ছেলেটার কাছে সব কিছু বলা যায়।
দুদিন পর শ্রাবণীর একটা চিঠি পায় নোবেল। ছোট্ট একটা চিঠি। “বাসা থেকে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে, আমার বাঁধা দেয়ার ক্ষমতা নেই। ক্ষমা কোরো, ভাল থেকো”।
পরের কয়েকটা দিন নোবেলের একটা ঘোরের মধ্যে কাটে। নীলয় তাকে অসম্ভব ব্যস্থ করে রাখে সারাটা দিন। এভাবে আগে কোন দিন নীলয়ের কাজের সাথে নিজেকে জড়ায়নি নোবেল, অথবা নীলয় জড়াতে চায়নি তাকে। নীলয় কি তাকে শ্রাবণীর কথা মনে করার, কষ্ট পাবার সুযোগ না দেয়ার জন্য এই কাজটা করছে? বুঝতে পারেনা নোবেল, কিন্তু গ্রামের খুব সাধারণ কিছু মানুষের মাঝে মিশে গিয়ে তাদের সুখ দুঃখের সাথী হতে বেশ ভালই লাগছে তার। কিন্তু মন থেকে কষ্টটা যাচ্ছেনা কিছুতেই।
ভালবাসা হারানোর কষ্ট অনেক গভীর। এই আজব সম্পর্কটার গভীরতা সুখের দিন গুলোতে যতটা না বোঝা যায়, তারচেয়ে বেশী বোঝা যায় কষ্টের মাঝে। হারিয়ে ফেলার পর বোঝা যায় সেই মানুষটা কতো আপন ছিল।
- - - - - - - -
“নীলয়, মা’কে শ্রাবণীর কথা কিছু বলিসনা, মা আমাকে অনেক ভালোবাসে, খামোখা কষ্ট পাবে মা” বাসে বসে কথা বলছিল দুই বন্ধু। মা ডেকে পাঠিয়েছেন, ঢাকায় যাচ্ছে নোবেল। নীলয়ের নাকি কি কাজ আছে, সেও সঙ্গী হয়েছে নোবেলের। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার, কিন্তু ঢাকায় না গিয়েও উপায় নেই। নীলয় সাথে যাওয়ায় ভালোই লাগছে, একা থাকাটা আরও বেশী কষ্টকর হত নোবেলের জন্য।
বাসায় ঢুকে অবাক হয়ে যায় নোবেল। কেমন যেন একটা উৎসব উৎসব ভাব বাসায়। কাজিনরা অনেকেই তার বাসায়, অথচ মা ফোনে তেমন কিছুই বলেননি তাকে। হয়তো কোন ফ্যামিলি ফাংশন আছে, অথবা অন্য কিছু, নোবেলের ভাল লাগছেনা কিছুই। নীলয়কে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো নোবেল।
“দেখ বাবা, তোকে না জানিয়ে আমরা তোর জন্য মেয়ে ঠিক করে ফেলেছি। হাতে বেশী সময় নেই, তুই নিজেই তো জানিস। আজকেই এনগেজমেন্ট। মেয়ে তোর অপছন্দ হবে না। আমরা সন্ধ্যার পর যাব। তুই ঝটপট গোসল করে শেভ করে নে বাবা। তারপর একটু রেস্ট কর” হতবাক নোবেলকে কথা কয়টা বলেই চলে গেলেন মা। মাথা পুরো এলোমেলো লাগছে তার। সে কি না করে দেবে মা’কে? কি ভাবে বলবে? কি যুক্তি দেখাবে এখন? সবার এই খুশী এক নিমিষে কি সে শেষ করে দেবে এখন? নীলয়টাও যে কোথায় গেলো।
- - - - - - --
কিছুই করতে পারেনি নোবেল। এমন পরিস্থিতিতে কিছু করা সম্ভবও না। নোবেল মনে মনে ক্ষমা করে দেয় শ্রাবনীকে। আসলে জীবনের নিজস্ব একটা গতি আছে, জীবন থেমে থাকেনা কখনই। বেঁচে থাকতে হলে মানুষকে আপোষ করতেই হয়। সময়ের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতেই হয়। ভালোবাসার মানুষ গুলোর দিকে তাকিয়ে, প্রিয় মুখ গুলোর তাকিয়ে, জন্মদাতা মা বাবা’র দিকে তাকিয়ে, আপন সন্তানের দিকে তাকিয়ে মানুষ নতুন আশার আলো দেখতে পায়। নিজের সুখটা তখন খুব সাধারণ হয়ে যায়।
আলো ঝলমলে ড্রয়িং রুমে নিজের আত্মীয় স্বজন আর অনেক অপরিচিত মানুষের মাঝে বসে আছে নোবেল। পরিচিত হচ্ছে অনেকের সাথে, টুকটাক প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। এমন সময় কনেকে নিয়ে ঘরে আসেন কনের মা, বড় বোন আর ভাবী। কনেকে বসানো হয় তার উলটো দিকের সোফায়। মাথা নিচু করে থাকে নোবেল। “নোবেল সাহেব, দেখেন তো, আমার বোনকে কেমন লাগছে আজকে” পরিচিত একটা কণ্ঠে সচকিত হয় নোবেল। আলো ঝলমলে ঘরটার সমস্ত আলোকে ম্লান করে দিয়ে তার সামনে বসে হীরের দ্যুতি ছড়াচ্ছে শ্রাবণী। নোবেলের শ্রাবণী। আর শ্রাবণীর ঠিক পেছনে, দরজার গায়ে হেলান দিয়ে কোকের গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে নীলয়, মুখে তার দুষ্টুমির হাসি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন