সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

প্রজাপতির পাখা অথবা রঙহীন শিউলি

প্রজাপতির পাখা অথবা রঙহীন শিউলি

কিছুদিন হল আমার অদ্ভুত একটা অসুখ হয়েছে। রাত ৩টা পর্যন্ত বিছানা এপাশ ওপাশ করি। তারপর খুব পাতলা ঘুম হয়।ঘুমটা গাঢ় হয় ভোর ছয়টার দিকে। কিন্তু পাখির ডাকের শব্দে ধড়মড় করে প্রতিদিন সোয়া ছয়টার দিকে আমার ঘুম ভাঙে। অনেকের ধারণা,পাখির ডাক অতি মধুর কোন শব্দ। কিন্তু ঘুমন্ত মানুষের কাছে পাখির ডাক বোমার শব্দের মতই ভয়ঙ্কর, বিশেষ করি সেটি যদি আপনার অ্যালার্ম ঘড়ির শব্দ হয় এবং ঠিক কানের কাছে বাজতে থাকে। আমি টলতে টলতে বিছানা থেকে উঠি। বিছানার মাঝখানে ঘুমন্ত তাথৈকে দেখে আমার মনটা মায়ায় ভরে যায়। তার কুকুরের মত কুণ্ডলী পাকিয়ে শোয়ার অভ্যাস আছে। এক হাত দিয়ে সে তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। প্রায়ই লালা ফেলে বালিশ ভিজিয়ে ফেলে। আমি তাথৈকে কোলে নিলাম। এই মার্চে আট বছরে পা দিয়েছে। বাবার মতই ফর্সা,মোটাসোটা গোলগাল। মামুন ওকে ডাকে "ফুটবল"। মাথায় এক রাশ চুল। হাসলে তার ফোলাফোলা গালে টোল পড়ে। আমি নিশ্চিত,পরীরাও তাদের শিশু বয়সে দেখতে এত সুন্দর হয়না।।
আমি তাথৈকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম। ঘুমের মধ্যেই সে হাত পা ছুঁড়ছে। কাতর স্বরে বলছে, "মা আমার পেট ব্যথা। স্কুলে যাবনা আজকে।"
এটা অবশ্য নতুন না, প্রতিদিনই স্কুলে যাওয়ার সময় তাথৈ এর পেট ব্যথা হয়। আমি পেস্ট লাগিয়ে ওর মুখের মধ্যে ব্রাশ ঢুকিয়ে দিলাম। তার চোখে পানি এসে গেছে। বড় বড় চোখে পানি নিয়ে ঠোঁট দুটো কামড়ে ধরে আছে। আমি মনে মনে বললাম, "আহারে আমার বাবুটা!"
স্কুলে যাওয়ার আগে চোখে পানি এনে ফেলার এই নাটকীয় অভ্যাস সে কিছুদিন হল আয়ত্ত করেছে। মামুন ঘুম থেকে উঠেছে। তাথৈ বাবাকে দেখেই দৌড়ে তার কোলের মধ্যে ঢুকে গেল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,"মা আমাকে স্কুলে পাঠিয়ে দিচ্ছে।" আমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করলাম। মেয়েটা একদম আমার মত হয়েছে। আমিও ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়া নিয়ে প্রচুর যন্ত্রণা করতাম। বাসা থেকে স্কুল পর্যন্ত পুরো রাস্তা বাবা আমাকে হ্যাচড়াতে হ্যাচড়াতে নিয়ে যেত। তাথৈকে স্কুলে পাঠিয়ে দেয়ার পর নিজে রেডি হয়ে, নাস্তা বানিয়ে বাসার কাজ গুছিয়ে হসপিটালে যেতে যেতে চোখের পলকে সকালটা কেটে যায়। তাথৈ এর স্কুল ছুটি হয় ১টায়। বাসায় ফিরে সে ল্যান্ডফোন থেকে আমাকে ফোন করে।
এবংপ্রতিদিনই বলে,
"মা আমার জন্য ভাল কিছু নিয়ে আসবা।"
"ভাল কিছু কি বাবু?"
"তা আমি কি জানি? তোমার মাথায় বুদ্ধি নাই? তুমি বুদ্ধি করে ভাল কিছু নিয়ে আস।"
"আচ্ছা বাবু।"
অফিস থেকে বাসায় ফিরলে তাথৈ কৌতূহলী চোখে আমার ব্যাগের দিকে তাকায়। আমি ঘরে ঢুকেই বলি, "আমার পুতুল বাচ্চাটা কোথায়?" তাথৈ উত্তরে মিষ্টি করে হাসে। তার সামনের দিকের দুটা দাঁত পড়ে গেছে। শিশুদের ফোকলা দাঁতের হাসি যে মানুষের মন নিমেষে ভাল করে দিতে পারে তা আমি এর আগে জানতাম না। মামুনের ফিরতে রাত হয়।সে ফিরেই হইচই শুরু করে। আমাকে বলে, "এই যে সেনোরিতা,আজকে রাতের মেনু কি? মেনু ভাল না হলে আমি আর আমার মেয়ে কিন্তু রাতে খাবনা। কিরে ফুটবল,মেনু যদি চিচিঙ্গা ভাজি হয় তুই খাবি?" তাথৈ গম্ভীর মুখ করে বলে,"তাথৈ চিচিঙ্গা ভাজি পছন্দ করেনা। সে মুরগির মাংস পছন্দ করে।"
রাতের খাবার শেষ করে আমাদের ছোট্ট সংসারে আড্ডা বসে। তাথৈ তার স্কুলের গল্প করে। তার ধারণা,তাদের স্কুলের বাথরুমে ভূত আছে। বাথরুমের পাশ দিয়ে কেউ গেলেই মিহি সুরে তার নাম ধরে ডাকে। মাঝে মাঝে বাচ্চাদের টিফিন খেতে চায়। আমি আর মামুন তাথৈয়ের গল্প শুনে হাসি। সে তখন মুখ গম্ভীর করে বলে, "ভূতদের নিয়ে হাসাহাসি করবে নাতো। তাহলে ওরা রাতের বেলা এসে কামড়ে দেবে।"
আমাদের হাসি তাতে আরও বাড়ে.....কিন্তু মেয়ের মুখ আরও গম্ভীর হয়। কেন জানি তার সেই জ্ঞানী গম্ভীর মুখ দেখেও আমার ভাল লাগে। মনে হয় বিধাতা আমার জীবন তার অপার মঙ্গলময়তায় ঢেকে দিয়েছেন। তার সেই করুনাধারায় আমার অতীত মুছে গেছে, সেই দুঃসহ অতীত......
মাঝে মাঝে আমার মনে পড়লেও বুক কেঁপে ওঠে।হঠাৎ পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়...... আমি শক্ত করে তখন মামুনের হাত চেপে ধরি।আমার চোখ দেখেই কিভাবে জানি মানুষটা সব বুঝে যায়।আরও শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে। কিছু বলেনা,কিন্তু এই নির্বাকতার মধ্যেই সে বুঝিয়ে দেয় -"এই হাত কখনও ছাড়বো না"।
আমার ছেলেবেলা কেটেছে হট্টগোলের মধ্যে। আমার বাবারা ছিল চার ভাই। চার ভাইতে অসম্ভব মিল। এদের বউরা সকাল বিকেল রাত সারাক্ষণই ঝগড়া করে বেড়ায়, কিন্তু ভাইদের কখনও ঝগড়া হয়না। চার পরিবার তাই এক বাড়িতেই থাকে। আমার দাদার বিশাল বাড়ি। তার ধারণা ছিল তার প্রত্যেক পুত্রই অপদার্থ। এদের দিয়ে জীবনে কিছুই হবেনা। তাই সারাজীবনের সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে বিশাল বাড়ি করে গেছেন। এবং ঘোষণা দিয়ে গেছেন এই বাড়ি যেন বিক্রি অথবা ভাগাভাগি না হয়।।
আমরা মোট ১৩ জন চাচাত ভাইবোন। বিভিন্ন সাইজের,বিভিন্ন বয়সের এবং বিভিন্ন স্বভাবের। বাসায় সব সময়েই আÍীয় অনাÍীয় এত লোকজন থাকত যে রাতে ঘুমানোর আগে ছাড়া মায়ের সাথেও খুব বেশি দেখা হতনা। বাড়ির সবচেয়ে ছোট মেয়ে হওয়ায় অস্বাভাবিক আদরে মানুষ হয়েছি। বাবা কোন কারণে বকা দিয়েছে,ব্যস চাচারা সবাই ছুটে এসেছে। মুরগির বুকের মাংসটা সবাই রেখে দিত,আমার পছন্দ বলে। রাতে কারেন্ট চলে গেছে,কোন না কোন চাচা ছুটে এসেছে পাখা নিয়ে,আমার যাতে ঘুমাতে কষ্ট না হয়। এত আদরে মানুষ হয়েছি বলেই কিনা জানিনা,হয়ত কিছুটা হাবাগোবা টাইপেরও ছিলাম।
তখন মাত্র ১৪ পেরিয়েছি। ফ্রক পড়ার জন্য বেশি বয়স,আবার কামিজ পড়ার জন্য কম বয়স। বয়সন্ধিকালের দুঃসহ সময়,যখন কাউকেই কিছু মন খুলে বলা যায়না। কথায় কথায় বলা হয়, "এরকম আর করা যাবেনা,এখন তুমি বড় হয়েছ।" অথচ নিজের এই বড় হয়ে যাওয়াটা সদ্য সাবেক হয়ে যাওয়া শিশু মন কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা। সবচেয়ে বড় শত্র“ তখন মনে হয় মাকে। মা কেন বন্ধুর বাড়ি যেতে দিতে চায়না,সন্ধ্যার পর কেন বাইরে থাকা যাবেনা,কেন জোরেজোরে হাসা যাবেনা সবকিছুতেই মায়ের সাথে তর্ক। এক রাতে মা খুব রাগারাগি করল। মায়ের খুব শখের নীল শাড়ীটা পড়েছিলাম, বেখেয়ালে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে শাড়ীর পাড়ের একটা জায়গা ছিঁড়ে গিয়েছিল। পুকুরপাড়ের লাগোয়া ঘরটায় মন খারাপ করে বসে আছি। হঠাৎ মেজো চাচা ঘরে এসে ঢুকল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আর তারপরেই আমার জীবনটা কেমন জানি হয়ে গেল।
আমার জ্ঞান ফিরেছিল গভীর রাতে। আমার সাথে কি হয়েছে,কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। সারা শরীরে তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরুলাম। সারা বাড়ি তখন ঘুমে তলিয়ে গেছে। আমি সব কিছু ঝাপসা দেখছি। মনে হচ্ছে সামনের সব কিছু পেন্ডুলামের মত দুলছে আর স্কুলের স্যার বেত হাতে নিয়ে সরু গলায় বলছে, "প্রতি সেকেন্ডে ৩ টি পূর্ণ দোলন স¤পন্ন করলে একটি দোলক ঘড়ির দোলনকাল কত?"
পরদিন সকালে প্রতিদিনের মতই সবাই একসাথে নাস্তা খেতে বসলাম। মেজো চাচার মেয়ে শিলাপু সেদিন সকালেই শ্বশুর বাড়ি থেকে এসেছে। পুরো বাড়িতে উৎসব উৎসব আমেজ। মেজো চাচার ব্যবহার অন্যদিনের মতই স্বাভাবিক। খুব হাসি ঠাট্টা করছে,গল্প করছে। মনে হচ্ছে কালকের রাতটা আসলে কখনও আসেইনি। আমাকে ভাজির প্লেট এগিয়ে দিতে দিতে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন......সেই লোমশ হাত......আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকি......
তারপর থেকে আমি আর কোন রাতে ঘুমাতাম না। ঘুমাতাম না বললে ভুল হবে,আসলে ঘুমাতে পারতাম না। ঘুমালেই স্বপ্ন দেখতাম,একটা লোমশ হাত আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে আমি ছটফট করছি। চিৎকার করছি,কিন্তু সেই সেই চিৎকার কেউ শুনতে পাচ্ছে না......
চারিদিকে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। আমার পুরো শরীর অবশ হয়ে গেছে। সেই সাথে ব্যথা,তীব্র ব্যথা......
আমার আচরণের পরিবর্তনটা খুব দ্রুত হল। কারও সাথেই তেমন কথা বলিনা, সারাদিন নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে থাকি। সারারাত ঘুমাইনা। স্কুল ছাড়া বাসার বাইরেও যাইনা। এসএসসি আর এইচএসসি দুটাতেই খুব ভাল রেজাল্ট করেছিলাম। বাসার সবার স্বপ্ন পূরণ করে সরকারী মেডিকেলেও চান্স পেয়ে গেলাম। সেখানেই মামুনের সাথে পরিচয়। ও আমার ব্যাচমেট ছিল। একদিন ক্লাস থেকে হলে ফেরার সময় সটান এসে সামনে দাঁড়িয়ে গেল।
"তোমার বিহেভ এত উইয়ার্ড কেন? ক্লাসে কারো সাথেই কথা বলনা, আমরা সবাই মিলে পিকনিকে গেলাম সেখানেও গেলেনা। এত ভাব দেখাও কেন?"
আমি কিছু না বলে চলে এলাম। কিন্তু মামুন ঠিকই আঠার মত লেগে থাকলো আমার পিছনে। একদিন আমাকে সামনে পেয়ে দুম করে বলে বসলো, "তোমার মত অহংকারী মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। আর আমার মত নির্বোধ খুব সম্ভবত তুমি জীবনে দেখনি। কারণ তোমাকে যদি কোন মহা নির্বোধও এই কথা বলতে চায়, অন্তত ছয় মাস ভাববে। তো ব্যাপারটা হল, তোমার কি আমাকে পছন্দ হয়?"
আমি আসলেও এমন নির্বোধ ছেলে জীবনে দেখিনি। মামুনকে একদিন বিকেলে ডেকে আমার সব কথা বলেছিলাম। কঠিন ভাষায় এবং তার চেয়েও কঠিন ভঙ্গিতে বলেছিলাম আমাকে নিয়ে স্বপ্ন না দেখতে। চলে আসার সময় দেখি,সে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়ছে। একটু পরপর হাতের তালু দিয়ে নাক মুছছে। আমি কাছে গিয়ে ওর পাশে বসলাম। মামুন শক্ত করে আমার হাত ধরল,আমি হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলাম,ও আরও শক্ত করে আমার হাত ধরল,তীব্র চোখে আমার দিকে তাকাল একবার। সেখান দিয়ে তখনও পানি ঝরছে। এতটা বছর যেই পাশবিক অভিজ্ঞতা আমি বয়ে বেড়িয়েছি,হঠাৎ যেন তার ভার আমার কাঁধ থেকে নেমে গেল। কেউ একজন আমার সেই দুঃখের ভাগ নিয়েছে, ঠিক সেভাবেই কাঁদছে যেভাবে এতটা বছর আমি কেঁদেছি......আমার মনে হল ধূসর পৃথিবীর রঙগুলো আবার ফিরে ফিরে আসছে......প্রজাপতির পাখার মত......গাঢ় হলুদ,মিষ্টি লাল,টুকটুকে বেগুনী অথবা চাপা সবুজ......
তাথৈ পাউরুটি মুখে নিয়ে বসে আছে।আমি কোমল গলায় বললাম, "মামনি,পাউরুটিটা শেষ করো। স্কুলবাস তো এসে গেছে।"
তাথৈ কঠিন গলায় বলল,"স্কুলে যাবনা।"
"কালকেও তো যাওনি।"
"আজকেও যাবনা।"
আমি আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না......
"তাথৈ চল বলছি। আমি কিন্তু তোকে পিটিয়ে লম্বা বানিয়ে ফেলব।"
আমার মেয়ের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। উফ,স্কুলে তো আর ওকে দিয়ে কেউ ইট ভাঙায় না। এত কান্নাকাটির কি আছে স্কুলে যাওয়ার সময়? আমি জোর করে ওকে স্কুলবাসে তুলে দিয়ে আসলাম। গভীর বেদনায় তার মুখ ছোট হয়ে গেছে......কেন জানি আমার খুব খারাপ লাগছে......
মামুন আর আমি দুজনেই খুব চিন্তায় আছি কদিন ধরে। তাথৈ দিনদিন কেমন যেন অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে। শিশুরা অদ্ভুত ব্যবহার করে,নাকি আমরা নিজেদের ব্যবহারটাকেই স্বাভাবিক মেনে নেই বলে ওদেরটা অদ্ভুত লাগে কে জানে। কিন্তু সারাক্ষণ যে মেয়ের মুখে কথার খই ফুটত,সে কোন কথাই বলে না, এটা আর যাই হোক স্বাভাবিক তো হতে পারেনা। সারাদিন আমি ওর পছন্দের কার্টুন চ্যানেল চালিয়ে রাখি, সেদিন ওয়ান্ডারল্যান্ডে তার প্রিয় ভূতের ট্রেনে চড়িয়ে আনলাম। তবু তার মুখে কোন উত্তেজনা নেই,হাসি নেই,আগ্রহ নেই।
আমি আর মামুন বারান্দায় বসে আছি। তাথৈ ঘুমিয়ে পড়েছে। মামুন খুব নিচু গলায় বলল, "ওর স্কুল ব্যাগটা এখনই গুছিয়ে দাও। সকালে তো কান্নাকাটি করতে করতেই সময় চলে যাবে। আমি তাথৈ এর ব্যাগ গুছিয়ে দেই।ওর ড্রয়িং খাতাটা ছিঁড়ে গেছে। খুব সুন্দর ছবি আঁকে তাথৈ। কয়েকটা পাতা উল্টে দেখলাম। এক পৃষ্ঠায় আমাদের ছবি এঁকেছে সে। নিচে লেখা-"মা আর বাবা।" কেন যেন চোখে পানি এসে গেল আমার।
পরের পৃষ্ঠা উল্টে আমি ছিটকে দূরে সরে গেলাম। থরথর করে সমস্ত শরীর কাঁপছে আমার। মনে হচ্ছে চারিদিকে কাঁচ ভাঙার আওয়াজ হচ্ছে। ছোট্ট একটা মেয়ের ছবি আঁকা সেখানে। পৃষ্ঠার বাকি পুরোটা জুড়ে একটা লোমশ হাত। সে বাচ্চা মেয়েটির দিকে থাবা বাড়িয়ে আছে...... সেখানে লেখা-ইংলিশ স্যার...
আমি পাগলের মত কাঁদছি, ঠিক বহু বছরের আগের সেই রাতের মত। মামুন ঘুমন্ত তাথৈকে কোলে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। আমার মনে হচ্ছে অসংখ্য ছুরির ফলা আমার বুকের মাঝখানে ছিঁড়েখুঁড়ে দিয়ে যাচ্ছে। এটা কি কোন দুষ্টচক্র? আমার উপর করাল গ্রাস ফেলে এখন আমার আট বছরের বাচ্চা মেয়েটার দিকে ধেয়ে আসছে। কি নি®পাপ লাগছে আমার ঘুমন্ত বাবুটাকে,ঠিক কতখানি পশু হলে এই শিশুটির সাথে এরকম আচরণ করা যায়?আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলো ওই দুঃসহ ঘটনার ভার বইতে গিয়ে হারিয়ে গেছে। আর সেখানে আমার মেয়েটার জীবনতো বলতে গেলে শুরুই হয়নি। ও কি সারাজীবন এমন অজানা আতঙ্কে কাটিয়ে দেবে?
না,বহু বছর আগের সেই আমির ছায়া আমার বাবুর উপর আমি পড়তে দেবনা। সেদিন এক অসহায় মেয়ে প্রতিবাদ করতে পারেনি,কিন্তু এক মা আজকে তার মেয়ের জন্য ঠিকই রুখে দাঁড়াবে। আমি চোখ মুছে আলতো করে তাথৈ এর মাথায় বিলি কাটলাম। জানালার ফাঁক দিয়ে মন ভাল করা কোমল আলো আসছে।ভোর হতে বেশি বাকি নেই।আমি জানি,কালকের ভোর নতুন হবে...... আলো আসবেই।
(এই গল্পের মত ঘটনা কিন্তু আমাদের সমাজে হরহামেশাই ঘটে। অনেক মেয়েই এই অসম্ভব যন্ত্রণাদায়ক ঘটনার মধ্য দিয়ে যায়। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা ঘটে খুব বাচ্চা বয়সে, যখন তার সাথে ঘটে যাওয়া এই পাশবিক ব্যাপারটা স¤পর্কে সে ঠিক মত বুঝেও উঠতে পারেনা। গল্পটা লিখতে গিয়েই আমি বারবার শিউরে উঠছিলাম, আর যাদের সাথে এমন ঘটেছে তারা কিসের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে সেটুকু ভাবার সাহসও আমার হচ্ছেনা। রাস্তা,স্কুল এমনকি নিজের বাসাও কন্যাশিশুদের জন্য নিরাপদ করতে পারিনি আমরা। কিন্তু অন্তত একটু সচেতন তো হতে পারি আমরা,আমাদের ছোট বোনটি অথবা আমাদের শিশু কন্যাটি যাতে অন্তত এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে না যায়। আমাদের মানবিকতা সব পাশবিকতাকে মুছে দিক-এটাই প্রার্থনা রইল।)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন