গল্পের নামঃ সুখের নীড়
শফিক সাহেব আছরের নামাজ পরেই একটু হাঁটতে বের হলেন। নামাজ পড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হুজুর পেছন থেকে ডাকলেন, তাই শফিক সাহেব দাড়িয়ে পড়লেন।
- আপনার তো মিলাদ পড়ানোর কথা, আপনি কি থাকবেন না?
- না হুজুর, আপনারাই পড়ান, আমি সব ব্যবস্থা আগেই করে দিয়ে গেছি, কিছু লাগলে আমাকে জানাবেন।
- না হুজুর, আপনারাই পড়ান, আমি সব ব্যবস্থা আগেই করে দিয়ে গেছি, কিছু লাগলে আমাকে জানাবেন।
কথাটা বলেই জবাবের অপেক্ষা না করেই শফিক সাহেব বেরিয়ে পরলেন। আজকের এই দিনটিতে তিনি কখনই মিলাদে অংশ নেন না। বলা যায় সৃষ্টিকর্তার উপর তিনি এক অজানা ক্ষোভ পুষে রেখেছেন। তিনি পায়ে হেঁটেই তার অতি পরিচিত এক জায়গার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। ১৫-২০ মিনিটের মাঝেই সেখানে পৌঁছে যান তিনি। সেখানে একটি কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। কবরটার দিকে তাকিয়ে একা একাই বলতে থাকেন, “এতটা নিষ্ঠুর তুমি কি করে হলে? কি করে আমাকে একা ফেলে চলে গেলে? আমায় না বলেছিলে কখনও একা ফেলে যাবে না? তবে কেন চলে গেলে? আমি কি করে বেঁচে আছি তা আমিই জানি। তুমি তো দিব্যি ঘুমাচ্ছ!” বলেই অঝোরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দেন। শফিক সাহেবের কান্না মুছে দিতেই কি না আকাশও মেঘলা করে বিদ্যুৎ চমকিয়ে বৃষ্টি ঝরায়। বৃষ্টিতে শফিক সাহেবের চোখের পানি ধুয়ে যায়।
এই দিনটা শফিক সাহেবের জীবনে সবচেয়ে বেশী কষ্টের দিন। এই দিনে তিনি তার ভালবাসার মানুষটাকে হারিয়ে ছিলেন। যাকে তিনি তার নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন, তার ভালবাসার মানুষ, তার অতি আদরের স্ত্রী “হৃদি”। আজ থেকে ১৫ বছর আগে এই দিনেই তাকে একা ফেলে হৃদি পরপারে চলে গেছেন। শফিক সাহেব বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাসার পথে রওয়ানা দেন। পথে তার পুরোনো সব স্মৃতি মনে পড়তে থাকে।
হৃদির সাথে শফিক সাহেবের পরিচয় ভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে, শফিক সাহেবের চেয়ে এক ব্যাচ জুনিয়র ছিল হৃদি। হৃদি দেখতে যেমন সুন্দরি ছিল, পড়াশোনাতেও ঠিক ততটাই ভাল ছিল। ভার্সিটির এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হৃদিকে প্রথম নাচতে দেখেন, এক দেখাতেই মেয়েটার প্রেমে পড়ে যান তিনি। শফিক সাহেবের ডাকনাম শুভ্র। ভার্সিটির সবাই তাকে শুভ্র নামেই ডাকত। শুভ্র একদিন হঠাৎ করেই হৃদিকে তার বন্ধুদের সামনে প্রেম নিবেদন করে বসে। চেনা নেই, জানা নেই, এমন এক ছেলে তাকে প্রেম নিবেদন করে বসে আছে! হৃদি কিছুটা রাগের বশেই শুভ্রকে চড় মেরে বসে। কিছুদিন পর হৃদিকে তারই এক বান্ধবী জানায় যে শুভ্র ভার্সিটির সেরা ছাত্রদের একজন, হৃদিকে অনুষ্ঠানে নাচতে দেখেই শুভ্রর ভাল লাগে, আর বোকা শুভ্রও না বুঝে শুনে তাকে প্রেম নিবেদন করে বসেছে। সেই ঘটনার পর থেকেই শুভ্র ভার্সিটিতে যাওয়া সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। এত কিছু শোনার পর হৃদির নিজের উপরই রাগ উঠে, সে শুভ্রর বন্ধুদের কাছে অনুরোধ করে যাতে একবার তাকে শুভ্রর সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেয়। হৃদি শুভ্রর কাছে তার এমন ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চায়, শুভ্রও তার এমন উদ্ভট কান্ডের জন্য ক্ষমা চায়। সেই থেকে তাদের মাঝে বন্ধুত্ব হয়, ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব যে কখন ভাল লাগায় পরিণত হয় তা হৃদি নিজেও জানে না। তাই একদিন হৃদি নিজেই শুভ্রকে নিজের মনের কথা জানিয়ে দেয়। শুভ্র যেন হাতের মুঠোয় চাঁদ পেয়ে বসে।
ভার্সিটি থেকে বের হয়েই শুভ্র ভাল একটা চাকরি পেয়ে যায়। চাকরি পেয়েই শুভ্র তার মা কে দিয়ে হৃদিদের বাসায় প্রস্তাব পাঠায়। হৃদির পরিবারও খোলামেলা মানসিকতার, তারা রাজী হয়ে যায়। ফলে ৬ মাস পরেই তাদের বিয়েটা ধুমধাম করে হয়ে যায়। নিজেদের সুখের নীড়ে দুই কপোত-কপোতি অনেক সুখে শান্তিতেই ছিল। ২ বছর পর হৃদি শুভ্রকে সুখবর দেয় যে তাদের ঘরে নতুন মেহমান আসছে, দুজনার সুখের আর কোন সীমানা থাকেনা। কিন্তু তাদের সুখে বাধা পরে যখন হৃদির ডেলিভারি সময় আসে। ডাক্তার শুভ্রকে হৃদি আর বাচ্চার মাঝে যে কোন একজনকে বেছে নিতে বলেন। শুভ্র হৃদিকেই বেছে নেয়, কিন্তু হৃদি যখন ডাক্তারের কাছে এই কথা শোনে তখন সে ডাক্তারকে অনুরোধ করে যাতে তার বাচ্চাটাকে বাঁচানো হয়।
হৃদি আর শুভ্রর ঘর আলো করে এক ফুটফুটে মেয়ে জন্ম নেয়। ডাক্তার দুইজনকেই বাঁচাতে সক্ষম হলেও হৃদির শারীরিক অবস্থা খুবই আশংকাজনক থাকে। হৃদি তার স্বামী শুভ্রর সাথে একটু কথা বলতে ডাক্তারদের কাছে আবদার জানায়। শুভ্র অশ্রু বিজরিত কন্ঠে হৃদিকে বলে,
- আমাকে ছেড়ে যেওনা, প্লিজ...
- তুমি কাঁদছ কেন? কাঁদলে কিন্তু আমার কষ্ট হবে। শোন, যখনই আমাকে মনে পরবে, আমাদের মেয়েটার দিকে তাকিও। আমাকেই দেখতে পাবে।
কথাগুলো বলার পরক্ষনেই ডাক্তাররা শফিক সাহেবকে রুম থেকে বের করে দেন। প্রায় ২ ঘন্টা মৃত্যুর সাথে লড়াই করে হৃদি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যায়।
শফিক সাহেব বাসায় ঢুকেন হাতে একটা কেক নিয়ে, আজ তার মেয়ের ১৫তম জন্মবার্ষিকী। তিনি আজ অবধি তার মেয়েকে ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে দেননি যে, আজ তার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। পাছে সে তার জন্মটাকে না অপয়া ভেবে বসে, সেজন্যে। তিনি তার মেয়েকে জানিয়েছেন যে তার জন্মের ২ সপ্তাহ পরে তার মা মারা গিয়েছে, আর সেইদিনই তিনি তার বাসাতে প্রতিবছর মিলাদ পড়ান। শফিক সাহেবের আত্মীয়স্বজন সবাই এই কথাটা ভাল করেই জানেন। শফিক সাহেব মেয়েকে ডাকেন,
- মা হৃদি, তোর দাদিকে নিয়ে এদিকে আয় তো মা।
- আসছি বাবা।
- আসছি বাবা।
মেয়ে বাবার হাতে কেক দেখে খুশিতে আটখানা। বলে,
- আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি ভুলেই গেছ বাবা।
- তোর জন্মদিন আমি কি করে ভুলি রে মা? আয় তো তাড়াতাড়ি, কেকটা কাটি।
- তোর জন্মদিন আমি কি করে ভুলি রে মা? আয় তো তাড়াতাড়ি, কেকটা কাটি।
মেয়ের চোখেমুখে খুশি দেখে শফিক সাহেবের চোখের কোণাটা ভিজে আসে। মেয়েটা দেখতে পুরো তার মায়ের মতই হয়েছে, এই মেয়েকে ঘিরেই এখন শফিক সাহেবের সুখের নীড়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন