লাল জুতো
‘বাজান! ও বাজান! কহন দিবা মোরে লাল জুতা? তুমি না কইছিলা নমাজ থেইহা আসনের সময় তুমি মোর লেইগা লাল জুতা আনবা? মোর মেলা দিনের শখ মুই লাল জুতা পইরা পানজাবি গতরত দিয়া খেলবার যামু। পানজাবি তো দিলানা, জুতাই দ্যাও। বাজান! ও বাজান! যাইবা না?’
কথাগুলো আজ কেন যেন বড় বেশি মনে পড়ছে শওকতের। হয়তো অকারণে নয়। আর সবার মত ঈদের দিনটা ওর জন্য আনন্দের নয়। বরং বড় কষ্টের, বেদনার। বড্ড যন্ত্রণার। সম্ভবত শওকত তার জীবনে সবথেকে বেশিবার এই ঘটনাটাকেই ভুলে যাবার চেষ্টা করেছে। পারেনি। বরং মনের অগোচরে সেই ঘটনাটাই আরেকবার তার চোখের পাতায় ভেসে ওঠে:
ঠিক এক বছর আগের কথা-
আবারও চুরির দায়ে ধরা পড়েছে শওকত। আজকে সে চৌধুরী বাড়ি থেকে পুরো এক সের চাল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। রান্নাঘর থেকে ধীর পায়ে নিঃশব্দে যখন সে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তখনই হঠাৎ আজুর মা তাকে দেখে ফেলে। তার চিৎকারে সাথে সাথে পুরো বাড়িতে হুলস্থূল কাণ্ড বেধে যায়। ধরা পড়তেও খুব বেশি সময় নেয় না। টানা চারদিন শুধু পানি খেয়ে থাকা একটা লোককে ধরতে খুব বেশি সময় লাগাটাও অসঙ্গত।
বাড়ির কয়েকজন জোয়ান লোকজন তাকে ধরে নিয়ে যায় গঞ্জের বটতলায়। সেখানে সালিশ বসবে শওকতের। উৎসুক জনতারও অভাব হয় না। তাদের উৎসাহ যতটা সালিশ দেখা তার থেকে বেশি সময় সুযোগ মত শওকতের গায়ে দু’চার ঘা বসিয়ে দেয়া। সুযোগও পাওয়া যায় অজস্র।
গঞ্জে পৌছতেই নতুন মোটা পাটের দড়ি দিয়ে শওকতকে বাধা হল। যেন পালানোর বিন্দুমাত্র সুযোগ না পায়। কিছুক্ষণ পরই চৌধুরী সাহেব এসে পড়লেন। রাগে তার সমস্ত শরীর যেন কাঁপছে। কিন্তু, তার মত লোকের কোথাও আগ বাড়িয়ে কথা বলাও সাজে না। তাই তিনি ধরা মুন্সির দিকে এক পলক তাকালেন। ইঙ্গিত বুঝে নিয়ে ধলা মুন্সি উঠে দাড়িয়ে বলতে শুরু করল, ‘কতা অইল গিয়া, আমাগো চউধুরি সাব অইলেন গেরামের মাতা। গ্রামের পরতেকটা লোক হেরে মান্যি করে। দান খয়রাতও আল্লায় দিলে মাশাল্লা ভালই করে। আর এই বেয়াক্কেইল্যা শওকইত্যার এত্ত বড় সাবাস! চউধুরি সাবের বাড়িত চুরি! তয়, আমাগো চউধুরি সাবের দিল আল্লায় দিলে সমুদ্দুরের লাহান। হে দোষীরেও কতা কওনের সুযোগ দেয়। ওই শওকইত্যা, তাতরি ক কিয়েরতে চুরি করছস?’
সালিশের এক কোণে নিশ্চল পাথরের মত পড়ে ছিল শওকত। ধরা পড়ার পর থেকে খাওয়া প্রচণ্ড মারে সারা শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছিল। দাড়িয়ে থাকার শক্তিটুকু এখন তার অবশিষ্ট নেই। তবু, তাকে দাড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। কারণ, সে বটগাছের সাথে বাধা। অনেক চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে কোন শব্দ করতে পারল না। শুধু বার কয়েক ঠোট নড়ল। তাতে অন্যদের মনে হল শওকত বিড়বিড় করে তাদের অভিশাপ দিচ্ছে।
ধরা মুন্সি চিৎকার করে বলল, ‘ওই হালা বাইনচোত! চুপ কইরা থাকলে মাতাডা এক্কেরে বাইন মাছ ছ্যাচা কইরা দিমু। তাতরি ক, চুরি ক্যান করছস?’
এবার মুখ খুলতেই হল শওকতকে, ‘সাব, আমার বংশ তো চোরের বংশ না। চোর তো আছিল না আমার বাপ-দাদায়। কিন্তুক, সাব হগল জ্বালা সযয করণ যায়, প্যাটের জ্বালা যায় না। আফনেরা হগলে শিকখিত লোক। আপনাগো ভাত কাপড়ের অবাব নাই। কিন্তু, আমার যে সব...’
এবার মুখ খুলতেই হল শওকতকে, ‘সাব, আমার বংশ তো চোরের বংশ না। চোর তো আছিল না আমার বাপ-দাদায়। কিন্তুক, সাব হগল জ্বালা সযয করণ যায়, প্যাটের জ্বালা যায় না। আফনেরা হগলে শিকখিত লোক। আপনাগো ভাত কাপড়ের অবাব নাই। কিন্তু, আমার যে সব...’
কথাটা বলার আগেই ডুকরে কেঁদে উঠল শওকত। কেটে যাওয়া ঠোট আর রক্তমাখা মুখে চোখের পানিগুলোকে দেখা গেল না। কিন্তু, সেটা তার কান্নাটাকে আরও বিকৃত রূপ দিল। কান্না-ভেজা জড়তাযুক্ত গলায়ই সে বলতে লাগল, ‘মোর যে সব বানের জলে...’
‘ওই হালা চোপ! চুপ কর কইছি।’ চিৎকার করে উঠল ধলা মুন্সি। কিন্তু, বলার মত কিছু মাথায় এলো না। তাই বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘তোরে আমি ভাল বুইজ্জা দুইটা কথা কইতে দিলাম, যাতে তর সাজাডা কমে। আর হ্যাতেনে লেকচার দেওন শুরু করছে। ল্যাকচার শুনবার লেইগা আইছে হগলে। ল্যাকচার! চউধুরি সাব শুরু করেন।’
একটা নড়েচড়ে বসলে চৌধুরী সাহেব। চেহারার রুক্ষতাটাকে খানিকটা কোমল করে নেবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু, চেপে রাখা প্রচণ্ড রাগে মুখটা আরও বিকৃত রূপ নিলো। বলতে শুরু করলেন, ‘আপনারা গ্রামের গণ্যমান্য লোক। শওকতের স্বভাবচরিত্র আপনাদের কারোরই অজানা নয়। এ নিয়ে বার ছ’য়েক ধরা পড়ল ও। শাস্তিও পেয়েছে প্রতিবার। কিন্তু, শিক্ষা হয় নি। তাই, আবার কোন সাহসে ও আমার বাড়িতে...’
প্রায় চিৎকার করে উঠলেন চৌধুরী সাহেব। রাগটা নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর হবে বুঝতে পেরে একটু থেমে বড় দুটো নিঃশ্বাস নিলেন। কাজ বোধহয় কিছুটা হল। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘আবার কোন সাহসে ও চুরি করতে পারল! তাই আমার সিদ্ধান্ত এবার ওকে বড় ধরনের শাস্তি দেয়া দরকার। কি মত আপনাদের?’
হ্যাঁ, না আর মন্তব্য একাকার হয়ে একটা শোরগোল সৃষ্টি করল। চৌধুরী সাহেব আর ধলা মুন্সি দু’জনেই এটাকে সমর্থন হিসেবেই ধরে নিলেন। উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাদের চোখ মুখ। অতি উৎসাহী হয়ে ধলা মুন্সি বলতে শুরু করল, ‘ধম্মে আছে চোরের একমাত্র শাস্তি তার হাত কাইটটা ফালানো। চউধুরি সাব মাটির মানুষ বইলাই এত দিন শওকত বহাল তবিয়তে আছে। তয় এইবার ছাড়ন যায় না। কেউ কি কিছু বলবেন?’
ভিড়ের মধ্যে অনেকেই হয়তো কিছু বলতে চাইল,কিন্তু কোলাহলে কিছু শোনা গেল না।
চৌধুরী সাহেব বললেন, ‘তাহলে শওকতের শাস্তি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হল।’
শাস্তি ঘোষণা হবার পর বেশ কয়েকজন উঠে চলে গেল। কেউ হয়তো বা পরের দৃশ্যের জন্য অপেক্ষা করল না। কেউ বা স্নায়ুবিক দুর্বল হওয়ায় শাস্তি দেখতে চাইল না। কিন্তু, কয়েকজন উঠে গেল শাস্তির বিরোধিতা করে; নিঃশব্দে। ধলা মুন্সি তাদের ডাকতে গিয়েও থেমে গেল। হাঁক ছেড়ে তার ছেলেকে ডাকলেন, ‘ওই আব্বাস, আমার চাপাতিটা নিয়া আয় তো’। আব্বাস এক ছুট দিয়ে বেরিয়ে গেল। একটু পরেই তা নিয়ে এসে বাবার হাতে দিল। ধলা মুন্সি সেটা চৌধুরী সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘শুভ কামডা আপনে নিজের হাতে করেন।’
কথাটা শুনে চৌধুরী সাহেব ধলা মুন্সির দিকে একটা ক্রুদ্ধ দৃষ্টি মেলে চাইল। তা দেখে আর কথা বাড়াল না ধলা মুন্সি। হাঁক ছেড়ে বলল, ‘কি মিয়ারা! খালি বইসা বইসা তামাশা দেখবা? না’কি কামে একটু সঙ্গ দিবা?’ বেশ কয়েকজন সামনে এগিয়ে এলো। ধলা মুন্সি বলল, ‘ওই বদের বান্ধন খুইলা মুগুরের উপ্রে রাখ।’
একজন এগিয়ে এসে শওকতের বাধন খুলে দিল। কয়েকজন মিলে তাকে নিয়ে গেল খানিকটা সামনে। ধলা মুন্সি শওকতের একটা হাত মুগুরের উপর রাখল। দুজন শক্তসমর্থ লোক শওকতকে ধরে রাখল। এত কিছু ঘটে যাচ্ছে কিন্তু শওকত নির্বিকার। তার কোন ভাবান্তর নেই কোন প্রতিক্রিয়া নেই। সে শুধু ভাবছে আজকেও সে একমুঠো ভাত জোগাড় করতে পারল না।
ধলা মুন্সি হাতে চাপাতিটা ধরল। তারপর নিজের মুখটাকে কঠিন করে একটা মানসিক প্রস্তুতি নিলো। তারপর আল্লাহু আকবর বলে একটা চিৎকার দিয়ে সজোরে চাপাতি দিয়ে একটা কোপ দিল। ছিটকে দুরে গিয়ে পড়ল কাটা হাতটা। দু’টো অংশ থেকেই তখন রক্ত ঝরছে।
‘বকর! ওই বকরের বাচ্চা! তাতরি বাইর।’ বাইরে থেকে চিৎকার করে উঠল ধলা মুন্সি।
বকর; শওকতের ছেলে। খড়ের এক টুকরো ছাদের নিচে দু’জনেই একসাথে থাকে। সেখান তেকে বকর সোল্লাসে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এলো, ‘বাজান ভাত আনছ?’ কিন্তু ঘর থেকে বেরিয়েই তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। চিৎকার করে শওকতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, ‘বাজান, কি অইছে? কি অইছে তোমার হাতের? ও মুনশি চাচা বাজানে কতা কয় না ক্যান?’ ক্রমাগত একটানা সকলের মুখের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে গেল। যদিও কারও কাছ থেকেই উত্তর আশা করেনি।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ধলা মুন্সি বলল, ‘এইবারের মত যে তোর বাপ জান নিয়া বাড়ি ফিরবার পারছে, সেইটাই তো তগো সাত পুরুষের ভাগ্য। এইবার তো খালি হাতের উপর দিয়া গেছে। পরের বার কইলাম জানের উপর দিয়া যাইব।’ বকর কিছু বুঝতে পারে না শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ধলা মুন্সি ফিরে যেতে গিয়ে আবার এসে বলল, ‘হাতটা কাপড় দিয়া বাইন্দা দিছি। রক্ত পড়া বন্দ অইলে কাপরডা বদলায় দিস।’ বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেল। আতঙ্কিত, স্তব্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে বকর।
খানিক বাদে সে শওকতকে ঘরের ভেতর নিয়ে গেল। ভাঙ্গা খাটটায় তাকে শুইয়ে দিয়ে, এক গ্লাস পানি নিয়ে গেল শওকতের কাছে। বুকের মাঝে কোথায় যেন চিনচিন করে ব্যথা হচ্ছিল, অসুস্থ, ক্ষুধার্ত বাবার সামনে শুধু পানি নিয়ে দাড়াতে। কিন্তু, তার কাছে অনুভূতিগুলো এখন আর অনুভবক্ষম নয়। হৃদয় থেকে কষ্ট, বেদনা আর যন্ত্রণাগুলোকে যতটা দুরে রাখা যায়, ততই মঙ্গল।
তৃষিতের মত পানিটুকু খেল শওকত। তারপর শ্রান্ত শরীর অবসন্ন হয়ে এলো। ক্লান্ত চোখ দু’টো অবসন্ন হয়ে বুজে এলো। যেন সে কত বছর ধরে ঘুমায় না।
ঘুম ভাঙ্গল টানা দু’দিন ঘুমোনোর পর। বকরের ডাকে। আলস্যের সাথে চোখ দু’টো খুলল। হঠাৎ, দুপুরের প্রচণ্ড আলো এসে চোখে পড়ায় সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিলো। একটু পরে অভ্যস্ত হয়ে এলে আবার চোখ দু’টো খোলে। তাকিয়ে, নিজের চোখকে শওকত বিশ্বাস করতে পারল না। তার সামনে থালা-ভর্তি ভাত নিয়ে দাড়িয়ে আছে বকর।
ঘুম ভাঙ্গল টানা দু’দিন ঘুমোনোর পর। বকরের ডাকে। আলস্যের সাথে চোখ দু’টো খুলল। হঠাৎ, দুপুরের প্রচণ্ড আলো এসে চোখে পড়ায় সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিলো। একটু পরে অভ্যস্ত হয়ে এলে আবার চোখ দু’টো খোলে। তাকিয়ে, নিজের চোখকে শওকত বিশ্বাস করতে পারল না। তার সামনে থালা-ভর্তি ভাত নিয়ে দাড়িয়ে আছে বকর।
মুখে একটুকরো হাসি টেনে বকর বলল, ‘করিমনের মায় দিছে। আর কইছে, কাউরে না কইতে।’ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বকর বলল, ‘খাইবা না?’
সাথে সাথে শওকত যেন সম্বিত ফিরে পেল। হেঁচকা টান দিয়ে বকরের কাছ থেকে থালাটা নিয়ে গোগ্রাসে খেতে লাগল সে। যেন যুগান্তরের ক্ষুধা যে এক মুহূর্তে মেটাবে। হোক না সে তলার পচা ভাত। যেটার মুরগির খাবার হবার কথা ছিল। তা না করে, তাদের দেয়া হয়েছে।
খানিকক্ষণের মধ্যেই ভাত প্রায় শেষ হয়ে এলো। হঠাৎ, বকরের কথা মনে পড়ল। দাতে জিভ কেটে বলল, ‘তুই খাইছস?’
‘আমার খাওন লাগব না। তুমি খাও। তোমার শরীর থেইকা কত রক্ত পড়ছে। তুমি খাও।’
‘না না। আমি খাইছি। তুই আমারে কবি না তুই খাস নাই।’ কথাটা বলে শূন্যপ্রায় ভাতের থালাটা ঠেলে দেয় বকরের দিকে। কোন কথা না বলেই বকর সেটুকু শেষ করল। এরপর গ্লাস চারেক পানি খেয়ে আবার এসে বসল শওকতের সামনে। খানিকটা আগ্রহী কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘বাজান, কাইলকা ঈদ মনে আছে?’
বিস্ময়াবিষ্ট কণ্ঠে শওকত উত্তর দিল, ‘কি কস! ঈদ তো পরশু।’
বিস্ময়াবিষ্ট কণ্ঠে শওকত উত্তর দিল, ‘কি কস! ঈদ তো পরশু।’
না বাজান, ঈদ কাইলকা। তুমি তো টানা দুইদিন ঘুমাইছ। বাজান আমারে লাল জুতা দিবানা?
‘অ’ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শওকত বলল, ‘দেখি।’
খানিকবাদে বকর আবার প্রশ্ন করল, ‘বাজান কাটনের সময় কি বেশি দুঃখ পাইছিলা?’
খানিকক্ষণ চুপ থাকল শওকত। তারপর একবার চোখ বুলাল কাটা হাতটার দিকে। প্রায় নিঃশব্দে উত্তর দিল, ‘মনে হয়।’
আজ ঈদ। ঈদ-উল-ফিতর। ভাঙ্গার আনন্দ। আনন্দ নিশ্চই আছে। শুধু অনুভব করাটা কষ্টের। প্রায় দুঃসাধ্য। তবু, শওকত চেষ্টা করছে আনন্দটাকে অনুভব করার। হয়তো পারছে। হয়তো না।
কিন্তু, বকরকে দেখে তার একরকম হিংসে হচ্ছে। যেন ঈদটা এসেছে শুধু বকরের দ্বারা অনুভূত হতে। কাল রাতে ঘুমোয়নি। গভীর রাত পর্যন্ত গ্রামের ছেলে মেয়েদর কোলাহল শুনেছে। তারপরের রাতটুকু কল্পনা করেছে সে নিজে যদি সেখানে থাকত তাহলে কি করত? ভোরে ফজরের আজান দেবার সময় আবার তার চিন্তাধারা বদলে গেছে। এখন ভাবছে লাল জুতো পাবার পর কি করবে?
বেশ ভোরেই সে শওকতকে ডেকে তুলেছে। বারবার তাড়া দিচ্ছে নামাজে যাবার জন্য। তার দু’চোখে মুখে রাজ্যের প্রত্যাশা। বারবার কেবলই বলে যাচ্ছে, ‘বাজান! ও বাজান! কহন দিবা মোরে লাল জুতা? তুমি না কইছিলাম নমাজ থেইহা আসনের সময় তুমি মোর লেইগা লাল জুতা আনবা? মোর মেলা দিনের শখ মুই লাল জুতা পইরা পানজামি গতরত দিয়া খেলবার যামু। পানজাবি তো দিলানা, জুতাই দ্যাও। বাজান! ও বাজান! যাইবা না?’
অবশেষে জ্বালাতনে অতিষ্ঠ হয়ে শওকত ঘর থেকে বের হল। প্রথমে ভেবেছিল খানিকক্ষণ বাইরে ঘোরাঘুরি করে ফিরে যাবে। কিন্তু, পরে কি মনে করে ঈদগাহে চলে গেল।
ওকে দেখে কয়েকজন কিছুটা নড়েচড়ে বসল। কয়েকজন কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। হয়তো ঈদ বলেই।
যথা নিয়মে, যথা সময়ে নামাজ শেষ হল। সবাই যার যার মত ফিরে গেল। শওকত ফেরার সময় জুতার স্তূপ থেকে এক জোড়া লাল জুতো উঠিয়ে নিলো। ছেড়া গেঞ্জির নিচে তা লুকিয়ে বাড়িতে ফিরে এলো।
জুতোজোড়া পেয়ে অসম্ভব খুশি হল বকর। পায়ে দিয়ে সাথে সাথে সে চলে গেল খেলার মাঠে। সে জানে তাকে কেউ খেলায় নেবে না। তবুও। অনেক আনন্দ নিয়ে মাঠে গিয়ে সে কিছুতেই ঠিক করতে পারছিল না এখন তার কি করা উচিত? মাঠের এক কোণায় দাড়িয়ে ভাবতে থাকে সে এখন কি করব?
মাঠের এক কোণায় বসে তখন নিঃশব্দে কাঁদছিল চৌধুরী সাহেবের ছোট নাতি। নতুন কেনা জুতো জোড়া আজকে সে নামাজ পড়তে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছে। হঠাৎ বকরের দিকে চোখ পড়ে তার। বকরের দিকে বললে ভুল হবে। চোখ পড়ে বকরের পা দু’টোর দিকে। তাকিয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। দৌড়ে সে ছুটে যায় তার বড় ভাইয়ের কাছে। মাঠের অন্য প্রান্তে তখন সে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলছিল। বকরকে দেখিয়ে সে বড় ভাইকে সব খুলে বলল।
সাথে সাথে চৌধুরী সাহেবের বড় নাতি ধাওয়া করল বকরকে। কারণ বুঝতে না পারলেও বকর এটুকু ঠিকই বুঝতে পারে ধরা পড়া তার জন্য সুখকর হবে না। তাই সেও প্রাণপণে ছুটতে থাকে।
পালানোর ভিন্ন কোন জায়গা না থাকায় সে বাড়ির দিকেই ছুটতে থাকে। তার বাড়িতে যাবার পথে একটা দিঘি আছে। পাশ দিয়ে যাবার রাস্তাটা বেশ সরু। বেশ দেখেশুনে চলতে হয়। অন্যদিক দিয়ে গেলে বেশ ঘুরে যেতে হয়। তাড়াতাড়ি যেতে বকর সেদিক দিয়েই দৌড় দিল।
হঠাৎ, দিঘির পানিতে পড়ে গেল বকর। সাতার জানত না সে। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে সে আর্তনাদ করে ওঠে, ‘বাজান! আমার লাল জুতা লাগব না। তুমি আমারে বাঁচাও।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন