মানুষ জীবন
হতাশ মানুষের গলায় একটা বাক্য প্রায়ই শোনা যায় ‘এটা কোন মানুষের জীবন হলো? কুকুরের জীবন কাটাচ্ছি!’ কিংবা ‘এর চেয়ে গরুর জীবন ভালো!’ ইত্যাদি। এ ধরনের উক্তির পেছনে কিন্তু একটা পৌরাণিক গল্প আছে। গল্পটা বরং শোনা যাক।
সৃষ্টির শুরুতে ঈশ্বর সকল জীবিত প্রাণীকে চল্লিশ বছর আয়ু নির্ধারণ করে দেন। তখন মানুষ বেঁকে বসে। তারা অভিযোগ জানায়- না প্রভু, এটা কীভাবে হয়? চল্লিশ বছর বাঁচলে জীবনটাই তো ঠিকমত শুরু করতে পারব না। তার আগেই জীবন শেষ!
মানুষের কান্নাকাটি শুনে তখন গরুর খুব দয়া হলো। গরু ঈশ্বরকে অনুরোধ করে বলল, প্রভু, আমার আয়ু চল্লিশ বছর। আমার আয়ু থেকে মানুষকে পনেরো বছর দিয়ে দিন।
ঈশ্বর তাই করলেন। মানুষের আয়ু হলো পঞ্চান্ন বছর। কিন্তু মানুষ তখনও নাখোশ।
মানুষ আবার ঈশ্বরের দরবারে হাজির হয়ে বলল, হে ঈশ্বর, পঞ্চান্ন বছর বাঁচলে বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করব কখন? আর সন্তান অমানুষ হলে বংশের মুখ রাখবে কে? আমাদের আরো সময় প্রয়োজন।
মানুষের কান্নাকাটি শুনে কুকুর এবার বলল, প্রভু ওরা যখন এত করে বলছে তখন আমার চল্লিশ বছর আয়ু থেকে ওদের পনেরো বছর দিয়ে দিন।
ঈশ্বর তাই করলেন। মানুষের এবার আয়ু হলো সত্তর বছর। কিন্তু মানুষ তখনও নাখোশ। সে পুনরায় ঈশ্বরের শরণাপন্ন হলো। এবার ঈশ্বর খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, তোমাকে তৈরি করাই আমার ভুল হয়েছে মনে হচ্ছে।
শুনে মানুষ বলল, প্রভু, একটা জিনিস ভুলে যাচ্ছেন। আপনার দয়ায় আমার আয়ু সত্তর বছর হয়েছে সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ।
ঈশ্বর মেজাজ হারিয়ে বললেন, আমার দয়ায় নয়, বল গরু আর কুকুরের দয়ায়।
- ঠিক আছে তাদের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। তারা তো আপনারই সৃষ্টি। কিন্তু আমি যেটা বলতে চাচ্ছিলাম সেটা হচ্ছে, সত্তর বছরের পর আমাদের আর কিছু আয়ু দরকার।
- কেন?
- কারণ জীবন তখন শেষ কিন্তু আপনার গুণগান গাইবার জন্য তো কিছু সময় দরকার নাকি?
ঈশ্বর এবার বিপাকে পড়লেন! তখন প্যাঁচা বলল, প্রভু আমার চল্লিশ বছর আয়ু থেকে ওকে আরো পনেরো বছর দিয়ে দিন।
ঈশ্বর তাই করলেন। এবার মানুষের আয়ু হলো পঁচাশি বছর। মানুষ এবার শান্ত হলো।
গল্প তো গল্পই। কিন্তু আমাদের বাস্তব জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে আমরা আসলে যেন মানুষ জীবন, গরু জীবন, কুকুর জীবন আর প্যাঁচার জীবনই অতিক্রম করে চলেছি। যেমন মানুষ তার প্রথম চল্লিশ বছরই সত্যিকারের মানুষের জীবন কাটায়। তারপর তার হুঁশ হয়- আরে! গাড়ি বাড়ি কিছুই তো হলো না। তখন সে গরুর মতো খাটতে শুরু করে বাড়ি-গাড়ির জন্য। এবার শুরু হয় তার কুকুর জীবন। তার সম্পত্তি রক্ষার জন্য সে ঘেউ ঘেউ শুরু করে। সব সময় সব কিছু খবরদারি করতে করতে তার কুকুর জীবন শেষ হয়ে আসে। শুরু হয় তার প্যাঁচার জীবন। এই জীবনে প্যাঁচার মতো রাতে ঘুমায় না সে। আসলে তার ঘুম আসে না। শরীরের সব কলকব্জা তখন বাতিলের দিকে। রাত জেগে ফেলে আসা জীবনের হিসাব-নিকাশ করে সে। অনেক ভুলের জন্য অনুশোচনা হয়। সে বসে বসে ভাবে আর আফসোস করে। সে তখন ঝিমায়। কেবলই ঝিমায়।
সব শেষে আমরা মানুষ জীবনের একটা সুন্দর উপসংহার টানতে পারি এ বিষয়ক একটা চমৎকার বাক্য দিয়ে। বাক্যটা অবশ্য এমন একজন মানুষের যিনি তার মানুষ জীবনে গরু, কুকুর বা প্যাঁচার জীবন ঢুকতে দেননি। তিনি বলেছেন, ‘তোমার জীবন হচ্ছে তোমাকেই খুঁজে বের করা, তুমি যে তুমিই সেটা আবিষ্কার করা!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন