সাদামাটা-মানুষের-গল্প
সিউল যাব। ঢাকা থেকে সরাসরি ফ্লাইট নেই বলে সিঙ্গাপুর ঘুরে যেতে হবে। ফলে আকাশপথেই থাকতে হবে ১১ ঘণ্টা। এই বিস্ময় সঙ্গে নিয়ে ঢাকা বিমানবন্দর যাচ্ছি।
ঈদের ছুটির রেশ তখনো পুরোপুরি কাটেনি। আমার ড্রাইভার জোরে গাড়ি চালাতে পছন্দ করেন। কাজেই ঈদের পরের এই সময়টা তাঁর খুব প্রিয়। কিন্তু সেদিন দেখি তাঁর মুখ ভার। হোটেল সোনারগাঁওয়ের সামনে এসে তিনি একটু গলা খাঁকারি দেন। বুঝলাম, এখন হৃদয়বিদারক কণ্ঠে তিনি কিছু বলবেন। এমন গলায় বলা তাঁর অধিকাংশ কথাই আসলে হৃদয়বিদারক হয় না। কিন্তু সেদিন হলো।
আমার ড্রাইভারের বাড়ি শ্রীপুর উপজেলার কোনো একটা গ্রামে। সেখানে ঈদের দুই দিন পর পুকুরে একটি মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে। মেয়েটি কে, তা কেউ জানে না। কিন্তু সে মারা যাওয়ার সময় সাজগোজ করা অবস্থায় ছিল। গায়ে নতুন কাপড় ছিল। আমার ড্রাইভার এই ঘটনা ঈদের ছুটির পর ফিরেই জানিয়েছিলেন। এখন তিনি জানালেন, এই লাশ নিয়ে পুলিশের তুলকালাম কাণ্ড চলছে গ্রামে। যাকে পাচ্ছে, তাকেই পুলিশ ধরে নিয়ে মামলায় আসামি করার ভয় দেখাচ্ছে। ‘বিশ-চল্লিশ’ হাজার টাকা না দিলে কারও আর রেহাই নেই। এই ভয়ে গ্রামের সব ছেলেরা পালিয়েছে। ভয়ে আমার ড্রাইভারও তাঁর স্কুলপড়ুয়া ১২ বছরের ছেলেকে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন। ঢাকায় তাকে এক আত্মীয়ের বাসায় রাখা হয়েছে। এখন তার খাওয়া-পরার জন্য কিছু টাকা দিতে হবে।
আমি বললাম, তা নাহয় দেওয়া গেল। কিন্তু ছেলের স্কুলের কী হবে? কত দিন সে এবং তার গ্রামের সব কিশোর-তরুণ পালিয়ে থাকবে? অসহায় বাবা জানালেন মামলার বাদী থাকলে হয়তো নির্দিষ্ট আসামি পাওয়া যেত। সেটি না পাওয়া পর্যন্ত পুলিশের হয়রানি চলবে। কেউ জানে না কবে তা শেষ হবে!
আমি ক্ষুব্ধ হয়ে বললাম, বলেন কী, এই অবস্থা দেশে! আমার ড্রাইভার একটু যেন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন আমাকে। আমার অজ্ঞানতায় অবাকই হলেন তিনি। ‘গাঁও-গেরামের খবর রাখেন না স্যার!’
আসলেই রাখি না। রাজনৈতিক কারণে অবাধে মামলা হয়, অজ্ঞাতনামা শত শত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়, এই সুযোগে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে অজস্র টাকা কামিয়ে নেয় পুলিশ। জমি দখলের জন্য, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য, ফাঁদে ফেলার জন্য মামলা করে ধড়িবাজ বা ক্ষমতাবান মানুষ। মাঝখান থেকে কিছু টাকা পকেটে যায় পুলিশের। কিন্তু যেখানে কলকাঠি নাড়ানোর কেউ নেই, সেখানেও পুলিশের এমন অবাধ বাণিজ্য!
দুই.
ঈদের দুই দিন পর পলাশী বাজারে গিয়েছি। বাজার থেকে বের হয়ে দেখি রিকশা নেই কোনো। কিছুক্ষণ পর দেখি হেলেদুলে রিকশা চালিয়ে একজন আসছেন। আমি তাঁকে বলি, ফুলার রোড যাবেন? তিনি ফুলার রোড চেনেন না। উদয়ন স্কুল চেনেন না। ব্রিটিশ কাউন্সিল তো নয়ই। ‘ইনভার্সিটি’? তিনি দার্শনিকের মতো ভঙ্গি করে উঠতে বললেন। কোনো কিছু না চিনলেও যেন তাঁর অসুবিধা নেই।
রিকশা চলা শুরু হলো। ফাঁকা রাস্তায় তাঁর রিকশা বারবার এদিক-সেদিক বেঁকে যায়। নিশ্চয়ই নতুন রিকশাচালক। কিন্তু না, তিনি জানান দুই মাস ধরে রিকশা চালান! আগে কী করতেন? ‘ব্যবসা’। কি ব্যবসা ভাই? ‘হিরুইন’! আমি চমকে উঠি! হেরোইন? ‘জি তাই!’ আমি আবারও অবাক হয়ে বলি, আপনি হেরোইনের ব্যবসা করতেন? জানেন না এটা কত খারাপ? তিনি পাশ ফিরে তাকান। তাঁর ময়লা ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত বের করে ম্লান হাসেন। তিনি আসলে হেরোইন বিক্রি করতেন। ভালো লাভ হতো। কিন্তু ধরা পড়ে মামলা খেয়েছেন তিনি। অনেক টাকা খরচ করে জামিন নিয়েছেন। এখন তিন-চার বছর ধরে তাঁকে বারবার আদালতে যেতে হয়। এ জন্য প্রচুর টাকা লাগে তাঁর। তিনি শুনেছেন ঢাকায় রিকশা চালালে টাকা বেশি। তাই তাঁর ঢাকা আগমন।
এই দীর্ঘ বক্তব্যের পর তিনি উদয়ন স্কুলের পাশে এসে হাঁপাতে থাকেন। রিকশা চালানোয় কিছুটা বিরতি। আমি তাঁকে প্রশ্ন করি: আপনি নিজে হেরোইন খান? না, খান না। তবে আগে খেতেন। করুণ কণ্ঠে বললেন, ‘ভাই রে, আমার মামলা শেষ হয় না ক্যান!’
বিড়বিড় করে তিনি বলেন, যারা বর্ডার থেকে হেরোইন আনে, তারা মামলা খায় না। বর্ডারে আর পুলিশকে টাকা দিয়ে সব ম্যানেজ করে। মামলা খায় শুধু তাঁর মতো বিক্রেতারা! আমি তাঁকে বলি, আপনি আর কখনো এসব করবেন না। করবেন?
তিনি নির্দ্বিধায় বলেন, ‘শরীর কুলাইলে করুম না!’ আমি রিকশা থেকে নেমে পড়ি। রিকশা চালানোর কষ্ট সহ্য করতে না পারলে তিনি আবার হেরোইন বিক্রি করবেন। আমার কিছু করার নেই! এই রাষ্ট্রের কারোরই কি কিছু করার আছে!
তিন.
তৃতীয় ঘটনাটি যাকে নিয়ে, সেই রাসেল আমারই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র। সে লালবাগের গোর-এ-শহীদ মাজারের কাছে কয়েক মাস আগে নতুন এক রেস্টুরেন্ট দিয়েছে। পুরান ঢাকায় এ ধরনের রেস্টুরেন্ট একটু ব্যতিক্রম। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ভেতরের সাজসজ্জায় নান্দনিকতা, হোটেলে কাজ করা তরুণদের স্মার্ট ব্যবহার। ঈদের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে আমি ও আমার স্ত্রী সেখানে গেলাম কিছুদিন আগে। আমাদের দেখেই রাসেল ছুটে এল। রোজার সময় দেখেছি এখানে মানুষের ভিড়। এখনো একই অবস্থা। আমি তাই হৃষ্ট গলায় বললাম, তোমার ব্যবসা তো ভালো জমে উঠেছে! রাসেল ক্ষুণ্ন গলায় জানাল, সে বরং রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তা করছে। আমি হতবাক! রাসেল জানাল, গ্যাসের লোক, পুলিশ, সিটি করপোরেশন আর নেতাদের টাকা দিতে দিতে সে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তার লাভের টাকা চলে যাচ্ছে এদের পকেটেই।
ব্যবসার এ অবস্থা হলে অন্য ‘হোটেল’গুলো চলছে কীভাবে? রাসেল জানাল, এভাবে চাঁদা আর ঘুষ দিতে হয় বলে অন্য হোটেলগুলো কম দামে মরা মুরগি, ভেজাল তেল, নিম্নমানের আটা-চাল ইত্যাদি ব্যবহার করছে। রাসেল এসব করবে না। সে সৎ ভাবে ব্যবসা করতে চায়। কিন্তু অল্পদিনেই সে বুঝে গেছে, লালবাগে এ কাজ সম্ভব নয়।
রাসেল কি সিরিয়াস? হ্যাঁ, সে সিরিয়াস। সে প্রশ্ন করে, ‘হয় আমাকে মরা মুরগি-ভেজাল তেল দিয়ে হোটেল চালাতে হবে অথবা বন্ধ করে দিতে হবে? আমি কোনটা করব, স্যার?’
চার.
আমি যখনই কোনো দেশে যাই, চোখ ঝলসানো উন্নতি, অসাধারণ নগর প্রশাসন বা সুখী কর্মব্যস্ত মানুষের ছবি দেখলে নিজের দেশের কথা খুব মনে পড়ে। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে সাদামাটা মানুষের নানা বঞ্চনার গল্প। এই মানুষগুলো বাধ্য হয় হেরোইন বিক্রি করতে, ভেজালের ব্যবসা করতে বা পুলিশ থেকে পালিয়ে বেড়াতে। বাধ্য হয় উদ্যম, সততা, কর্মস্পৃহাকে কলুষিত করতে।
প্রতিদিন, প্রতি মাসে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটে আমাদের চারপাশে। আমাদের চোখ, হৃদয় আর মস্তিষ্ক অভ্যস্ত হয়ে গেছে এসব দেখে। যে দেশে গৃহকর্মীকে ঝলসানো হয় খুন্তির আগুনে, শিশুকে হত্যা করা হয় পায়ুপথে হাওয়া ঢুকিয়ে, সাংবাদিক দম্পতিকে ছুরির আঘাতে হত্যা করা হয় তাদের শিশুসন্তানকে আটকে রেখে, যে দেশে মানুষের ঠাঁই হয় অন্য দেশের গণকবরে, যে দেশে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয় গানপাউডার বা পেট্রলবোমায়, যে দেশে পোড়া লাশের বীভৎস ছবি বিশাল পোস্টার করে সারা দেশের দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়, সেই দেশে কোনো ড্রাইভার, খুদে ব্যবসায়ী বা রিকশাচালকের ভোগান্তির গল্প খুবই অনুল্লেখ্য হয়তো!
আমি কোরিয়া থেকে ফেরার পথে ভাবি কোরিয়ার উঠে দাঁড়ানোর গল্প লিখব। জাপানের উপনিবেশ, উত্তর কোরিয়া, চীন আর সোভিয়েত আক্রমণের ইতিহাস, দেশ বাঁচাতে বিলিয়ন ডলার খরচ করে মার্কিন সেনা পোষা—এত সব প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়িয়েছে স্যামসাং আর এলজির দেশ। তারা অলিম্পিক আর বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করে, তাদের দেশের মানুষ হয় জাতিসংঘের মহাসচিব, তাদের অর্থনীতি তুলনীয় হয়ে ওঠে ইউরোপের সমৃদ্ধ দেশের সঙ্গে। এমন উত্থানের গল্প বলাতেও শান্তি অনেক!
কিন্তু কোরিয়া থেকে ফিরে ঢাকা এয়ারপোর্টে ঢুকে ভালো গল্প বলার ইচ্ছা চলে যায়। এরাইভেলের এস্কেলেটর থেকে নামতেই ফ্লোরে রাখা কুৎসিত এক বিজ্ঞাপন-বোর্ড। ইমিগ্রেশনে বিদেশফেরত বাঙালি জাতির প্রতি সীমাহীন তাচ্ছিল্য নিয়ে বসে থাকা আমার দেশের পুলিশ!
সবচেয়ে বড় ভোগান্তি কনভেয়ার বেল্টের সামনে। আমরা ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমেছি রাত সাড়ে ১১টায়। এমনিতেই অনেক রাত। তারপরও আধঘণ্টা যায়, এক ঘণ্টা যায়—লাগেজ আর আসে না। পেছনে-সামনে মানুষের সীমাহীন বিরক্তি! একসময় তা রূপ নেয় গালাগালিতে। আমার সামনে জাপান বা কোরিয়ার চেহারার এক বিদেশি। সে একসময় না থাকতে পেরে আমাকে প্রশ্ন করে, ‘ইজ দেয়ার অ্যানি প্রবলেম!’
আমি তাকে বলতে পারি না, দেয়ার আর মেনি প্রবলেমস! বিশাল উড়ালসড়ক, মধ্যম আয়ের দেশের অহংকার, রাজপথে চোখ ঝলসানো গাড়ির ভিড়, নতুন নতুন গলফ-গার্ডেন, জীবিত ও মৃত নেতাদের নানা স্বপ্ন—কিছুই এসব সমস্যা দূর করতে পারেনি।
এসব সমস্যা বলাও যেন অপরাধ এ দেশে। বললে চেতনাবিরোধী বা ছিদ্রান্বেষী গালি খেতে হবে। কঠিনভাবে বললে মামলা খেতে হবে, জেলে যেতে হবে বা আরও ভয়াবহ পরিণতি মেনে নিতে হবে।
দেয়ার আর মেনি মেনি প্রবলেমস!
ঈদের ছুটির রেশ তখনো পুরোপুরি কাটেনি। আমার ড্রাইভার জোরে গাড়ি চালাতে পছন্দ করেন। কাজেই ঈদের পরের এই সময়টা তাঁর খুব প্রিয়। কিন্তু সেদিন দেখি তাঁর মুখ ভার। হোটেল সোনারগাঁওয়ের সামনে এসে তিনি একটু গলা খাঁকারি দেন। বুঝলাম, এখন হৃদয়বিদারক কণ্ঠে তিনি কিছু বলবেন। এমন গলায় বলা তাঁর অধিকাংশ কথাই আসলে হৃদয়বিদারক হয় না। কিন্তু সেদিন হলো।
আমার ড্রাইভারের বাড়ি শ্রীপুর উপজেলার কোনো একটা গ্রামে। সেখানে ঈদের দুই দিন পর পুকুরে একটি মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে। মেয়েটি কে, তা কেউ জানে না। কিন্তু সে মারা যাওয়ার সময় সাজগোজ করা অবস্থায় ছিল। গায়ে নতুন কাপড় ছিল। আমার ড্রাইভার এই ঘটনা ঈদের ছুটির পর ফিরেই জানিয়েছিলেন। এখন তিনি জানালেন, এই লাশ নিয়ে পুলিশের তুলকালাম কাণ্ড চলছে গ্রামে। যাকে পাচ্ছে, তাকেই পুলিশ ধরে নিয়ে মামলায় আসামি করার ভয় দেখাচ্ছে। ‘বিশ-চল্লিশ’ হাজার টাকা না দিলে কারও আর রেহাই নেই। এই ভয়ে গ্রামের সব ছেলেরা পালিয়েছে। ভয়ে আমার ড্রাইভারও তাঁর স্কুলপড়ুয়া ১২ বছরের ছেলেকে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন। ঢাকায় তাকে এক আত্মীয়ের বাসায় রাখা হয়েছে। এখন তার খাওয়া-পরার জন্য কিছু টাকা দিতে হবে।
আমি বললাম, তা নাহয় দেওয়া গেল। কিন্তু ছেলের স্কুলের কী হবে? কত দিন সে এবং তার গ্রামের সব কিশোর-তরুণ পালিয়ে থাকবে? অসহায় বাবা জানালেন মামলার বাদী থাকলে হয়তো নির্দিষ্ট আসামি পাওয়া যেত। সেটি না পাওয়া পর্যন্ত পুলিশের হয়রানি চলবে। কেউ জানে না কবে তা শেষ হবে!
আমি ক্ষুব্ধ হয়ে বললাম, বলেন কী, এই অবস্থা দেশে! আমার ড্রাইভার একটু যেন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন আমাকে। আমার অজ্ঞানতায় অবাকই হলেন তিনি। ‘গাঁও-গেরামের খবর রাখেন না স্যার!’
আসলেই রাখি না। রাজনৈতিক কারণে অবাধে মামলা হয়, অজ্ঞাতনামা শত শত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়, এই সুযোগে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে অজস্র টাকা কামিয়ে নেয় পুলিশ। জমি দখলের জন্য, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য, ফাঁদে ফেলার জন্য মামলা করে ধড়িবাজ বা ক্ষমতাবান মানুষ। মাঝখান থেকে কিছু টাকা পকেটে যায় পুলিশের। কিন্তু যেখানে কলকাঠি নাড়ানোর কেউ নেই, সেখানেও পুলিশের এমন অবাধ বাণিজ্য!
ঈদের দুই দিন পর পলাশী বাজারে গিয়েছি। বাজার থেকে বের হয়ে দেখি রিকশা নেই কোনো। কিছুক্ষণ পর দেখি হেলেদুলে রিকশা চালিয়ে একজন আসছেন। আমি তাঁকে বলি, ফুলার রোড যাবেন? তিনি ফুলার রোড চেনেন না। উদয়ন স্কুল চেনেন না। ব্রিটিশ কাউন্সিল তো নয়ই। ‘ইনভার্সিটি’? তিনি দার্শনিকের মতো ভঙ্গি করে উঠতে বললেন। কোনো কিছু না চিনলেও যেন তাঁর অসুবিধা নেই।
রিকশা চলা শুরু হলো। ফাঁকা রাস্তায় তাঁর রিকশা বারবার এদিক-সেদিক বেঁকে যায়। নিশ্চয়ই নতুন রিকশাচালক। কিন্তু না, তিনি জানান দুই মাস ধরে রিকশা চালান! আগে কী করতেন? ‘ব্যবসা’। কি ব্যবসা ভাই? ‘হিরুইন’! আমি চমকে উঠি! হেরোইন? ‘জি তাই!’ আমি আবারও অবাক হয়ে বলি, আপনি হেরোইনের ব্যবসা করতেন? জানেন না এটা কত খারাপ? তিনি পাশ ফিরে তাকান। তাঁর ময়লা ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত বের করে ম্লান হাসেন। তিনি আসলে হেরোইন বিক্রি করতেন। ভালো লাভ হতো। কিন্তু ধরা পড়ে মামলা খেয়েছেন তিনি। অনেক টাকা খরচ করে জামিন নিয়েছেন। এখন তিন-চার বছর ধরে তাঁকে বারবার আদালতে যেতে হয়। এ জন্য প্রচুর টাকা লাগে তাঁর। তিনি শুনেছেন ঢাকায় রিকশা চালালে টাকা বেশি। তাই তাঁর ঢাকা আগমন।
এই দীর্ঘ বক্তব্যের পর তিনি উদয়ন স্কুলের পাশে এসে হাঁপাতে থাকেন। রিকশা চালানোয় কিছুটা বিরতি। আমি তাঁকে প্রশ্ন করি: আপনি নিজে হেরোইন খান? না, খান না। তবে আগে খেতেন। করুণ কণ্ঠে বললেন, ‘ভাই রে, আমার মামলা শেষ হয় না ক্যান!’
বিড়বিড় করে তিনি বলেন, যারা বর্ডার থেকে হেরোইন আনে, তারা মামলা খায় না। বর্ডারে আর পুলিশকে টাকা দিয়ে সব ম্যানেজ করে। মামলা খায় শুধু তাঁর মতো বিক্রেতারা! আমি তাঁকে বলি, আপনি আর কখনো এসব করবেন না। করবেন?
তিনি নির্দ্বিধায় বলেন, ‘শরীর কুলাইলে করুম না!’ আমি রিকশা থেকে নেমে পড়ি। রিকশা চালানোর কষ্ট সহ্য করতে না পারলে তিনি আবার হেরোইন বিক্রি করবেন। আমার কিছু করার নেই! এই রাষ্ট্রের কারোরই কি কিছু করার আছে!
তৃতীয় ঘটনাটি যাকে নিয়ে, সেই রাসেল আমারই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র। সে লালবাগের গোর-এ-শহীদ মাজারের কাছে কয়েক মাস আগে নতুন এক রেস্টুরেন্ট দিয়েছে। পুরান ঢাকায় এ ধরনের রেস্টুরেন্ট একটু ব্যতিক্রম। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ভেতরের সাজসজ্জায় নান্দনিকতা, হোটেলে কাজ করা তরুণদের স্মার্ট ব্যবহার। ঈদের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে আমি ও আমার স্ত্রী সেখানে গেলাম কিছুদিন আগে। আমাদের দেখেই রাসেল ছুটে এল। রোজার সময় দেখেছি এখানে মানুষের ভিড়। এখনো একই অবস্থা। আমি তাই হৃষ্ট গলায় বললাম, তোমার ব্যবসা তো ভালো জমে উঠেছে! রাসেল ক্ষুণ্ন গলায় জানাল, সে বরং রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তা করছে। আমি হতবাক! রাসেল জানাল, গ্যাসের লোক, পুলিশ, সিটি করপোরেশন আর নেতাদের টাকা দিতে দিতে সে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তার লাভের টাকা চলে যাচ্ছে এদের পকেটেই।
ব্যবসার এ অবস্থা হলে অন্য ‘হোটেল’গুলো চলছে কীভাবে? রাসেল জানাল, এভাবে চাঁদা আর ঘুষ দিতে হয় বলে অন্য হোটেলগুলো কম দামে মরা মুরগি, ভেজাল তেল, নিম্নমানের আটা-চাল ইত্যাদি ব্যবহার করছে। রাসেল এসব করবে না। সে সৎ ভাবে ব্যবসা করতে চায়। কিন্তু অল্পদিনেই সে বুঝে গেছে, লালবাগে এ কাজ সম্ভব নয়।
রাসেল কি সিরিয়াস? হ্যাঁ, সে সিরিয়াস। সে প্রশ্ন করে, ‘হয় আমাকে মরা মুরগি-ভেজাল তেল দিয়ে হোটেল চালাতে হবে অথবা বন্ধ করে দিতে হবে? আমি কোনটা করব, স্যার?’
আমি যখনই কোনো দেশে যাই, চোখ ঝলসানো উন্নতি, অসাধারণ নগর প্রশাসন বা সুখী কর্মব্যস্ত মানুষের ছবি দেখলে নিজের দেশের কথা খুব মনে পড়ে। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে সাদামাটা মানুষের নানা বঞ্চনার গল্প। এই মানুষগুলো বাধ্য হয় হেরোইন বিক্রি করতে, ভেজালের ব্যবসা করতে বা পুলিশ থেকে পালিয়ে বেড়াতে। বাধ্য হয় উদ্যম, সততা, কর্মস্পৃহাকে কলুষিত করতে।
প্রতিদিন, প্রতি মাসে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটে আমাদের চারপাশে। আমাদের চোখ, হৃদয় আর মস্তিষ্ক অভ্যস্ত হয়ে গেছে এসব দেখে। যে দেশে গৃহকর্মীকে ঝলসানো হয় খুন্তির আগুনে, শিশুকে হত্যা করা হয় পায়ুপথে হাওয়া ঢুকিয়ে, সাংবাদিক দম্পতিকে ছুরির আঘাতে হত্যা করা হয় তাদের শিশুসন্তানকে আটকে রেখে, যে দেশে মানুষের ঠাঁই হয় অন্য দেশের গণকবরে, যে দেশে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয় গানপাউডার বা পেট্রলবোমায়, যে দেশে পোড়া লাশের বীভৎস ছবি বিশাল পোস্টার করে সারা দেশের দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়, সেই দেশে কোনো ড্রাইভার, খুদে ব্যবসায়ী বা রিকশাচালকের ভোগান্তির গল্প খুবই অনুল্লেখ্য হয়তো!
আমি কোরিয়া থেকে ফেরার পথে ভাবি কোরিয়ার উঠে দাঁড়ানোর গল্প লিখব। জাপানের উপনিবেশ, উত্তর কোরিয়া, চীন আর সোভিয়েত আক্রমণের ইতিহাস, দেশ বাঁচাতে বিলিয়ন ডলার খরচ করে মার্কিন সেনা পোষা—এত সব প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়িয়েছে স্যামসাং আর এলজির দেশ। তারা অলিম্পিক আর বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করে, তাদের দেশের মানুষ হয় জাতিসংঘের মহাসচিব, তাদের অর্থনীতি তুলনীয় হয়ে ওঠে ইউরোপের সমৃদ্ধ দেশের সঙ্গে। এমন উত্থানের গল্প বলাতেও শান্তি অনেক!
কিন্তু কোরিয়া থেকে ফিরে ঢাকা এয়ারপোর্টে ঢুকে ভালো গল্প বলার ইচ্ছা চলে যায়। এরাইভেলের এস্কেলেটর থেকে নামতেই ফ্লোরে রাখা কুৎসিত এক বিজ্ঞাপন-বোর্ড। ইমিগ্রেশনে বিদেশফেরত বাঙালি জাতির প্রতি সীমাহীন তাচ্ছিল্য নিয়ে বসে থাকা আমার দেশের পুলিশ!
সবচেয়ে বড় ভোগান্তি কনভেয়ার বেল্টের সামনে। আমরা ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমেছি রাত সাড়ে ১১টায়। এমনিতেই অনেক রাত। তারপরও আধঘণ্টা যায়, এক ঘণ্টা যায়—লাগেজ আর আসে না। পেছনে-সামনে মানুষের সীমাহীন বিরক্তি! একসময় তা রূপ নেয় গালাগালিতে। আমার সামনে জাপান বা কোরিয়ার চেহারার এক বিদেশি। সে একসময় না থাকতে পেরে আমাকে প্রশ্ন করে, ‘ইজ দেয়ার অ্যানি প্রবলেম!’
আমি তাকে বলতে পারি না, দেয়ার আর মেনি প্রবলেমস! বিশাল উড়ালসড়ক, মধ্যম আয়ের দেশের অহংকার, রাজপথে চোখ ঝলসানো গাড়ির ভিড়, নতুন নতুন গলফ-গার্ডেন, জীবিত ও মৃত নেতাদের নানা স্বপ্ন—কিছুই এসব সমস্যা দূর করতে পারেনি।
এসব সমস্যা বলাও যেন অপরাধ এ দেশে। বললে চেতনাবিরোধী বা ছিদ্রান্বেষী গালি খেতে হবে। কঠিনভাবে বললে মামলা খেতে হবে, জেলে যেতে হবে বা আরও ভয়াবহ পরিণতি মেনে নিতে হবে।
দেয়ার আর মেনি মেনি প্রবলেমস!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন